দীর্ঘ ৭ বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ৩৯ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটিতে মোস্তাফিজুর রহমান বাবুকে সভাপতি এবং আসাদুল্লাহ-হিল গালিবকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। তবে কমিটির সিংহভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছেন অনেক আগেই। ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে সান্ধ্যকালীন ও শর্ট টাইম কোর্স করছেন। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে জাল সনদে ভর্তি, মাদক ব্যবসাসহ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার।
শনিবার (২১ অক্টোবর) রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কমিটি ঘোষণা করা হয়।
কমিটিতে সহ-সভাপতি হিসেবে ২০ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। তারা হলেন – মোঃ মেজবাহুল ইসলাম, শাহিনুল ইসলাম সরকার ডন, জাকিরুল ইসলাম জ্যাক, মোঃ মঈনউদ্দিন রাহাত, মোঃ মেহেদী হাসান মিশু, মেহেদী হাসান তায়েব, মোঃ মামুন শেখ, মোঃ নূর সালাম, আলতাফ সায়েম জেমস, আশিকুর রহমান আশিক, তাওহীদুল ইসলাম দুর্জয়, আল আমিন মোঃ তানভীর।
এছাড়াও সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন – তামান্না আক্তার তন্বী, আবুল বাশার আহম্মেদ, জান্নাতুল নাঈমা আকন্দ জানা, সামিউল আলম সোহাগ, মোঃ মোমিন ইসলাম, শাখাওয়াত হোসেন শাকিল, মোঃ জুয়েল হোসেন এবং মনু চন্দ্র মোহন দেব বর্মন।
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ৮ জন হলেন- ভাস্কর সাহা, মোঃ নাঈম আলী, নিয়াজ মোর্শেদ, মোঃ আশিকুর রহমান অপু, আব্দুল্লাহ আল মামুন স্বদেশ, তাজরিন আহমেদ মেধা , সাদেকুল ইসলাম সাদিক এবং মোঃ শামীম হোসেন ।
এছাড়া ৩৯ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন ৯ জন। তারা হলেন – মোঃ কাব্বিরুজ্জামান রুহুল, আল মুক্তাদির তরঙ্গ, প্রিয়াংকা সেন মৌ, ইমরান হোসেন, বুলবুল জোয়ার্দার, মোঃ জুবায়ের হাসান, নাশরাত আর্শিয়ানা ঐশী, জাহিদ হাসান সোহাগ এবং মোঃ কাইয়ুম মিয়া।
বিশ্ববিদ্যালয় ও শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা-কর্মী সূত্রে জানা যায়, নতুন ঘোষিত কমিটির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং তার বাসা জয়পুরহাট জেলার সদর উপজেলায়। ২০১৮ সালে অনার্স এবং পরের বছর মাস্টার্স শেষ করে এখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব আদার ল্যাংগুয়েজ নামক একটি শর্ট কোর্সে ভর্তি আছে। অভিযোগ আছে তিনি দীর্ঘ সময় রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। সম্মেলন কে ঘিরে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন।
নতুন ঘোষিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ-হিল-গালিব। তিনি রাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (আইআর) বিভাগে ২০১৪-১৫ সেশনে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রথম বর্ষে কৃতকার্য হয়ে দ্বিতীয় বর্ষে উঠলেও দ্বিতীয় বর্ষ টপকাতে পারেননি গালিব। এসময় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে একাডেমিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ড্রপআইট হন গালিব। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ পেতে ঢাকার উত্তরার ১৫ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত ‘অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’থেকে বিবিএ পাসের জাল সনদপত্র (রেজিস্ট্রেশন নম্বর-৭৭-০০১৩-১২৪) বানিয়ে রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হন।
এরপর অনুসন্ধানে জানা যায়, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কামরান চৌধুরী স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, গালিব ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেনি। এমনকি ৭৭-০০১৩-১২৪ রেজিস্ট্রেশন নম্বরে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সার্টিফিকেটটি জমা দিয়ে গালিব সাংবাদিকতা বিভাগের সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হয়েছে সেটি ভুয়া। এছাড়াও গালিবের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও কমিটির সহ-সভাপতি মোঃ মেজবাহুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালে অনার্স এবং পরের বছর মাস্টার্স শেষ করেন। এরপর ছাত্রত্ব ধরে রাখতে তিনি বিশ^বিদ্যালয়ের ইংলিশ এন্ড আদার ল্যাংগুয়েজ এর ইংলিশ ভাষা শিক্ষা কোর্সে ভর্তি আছে বলে অভিযোগ আছে। এছাড়া তার পরিবার বিএনপি-জামায়াতপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে ক্যাস্পাসে প্রচার আছে।
সহ-সভাপতি শাহিনুল ইসলাম সরকার ডন বিশ^বিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগে ভর্তি হন ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে। ২০১৬ সালে অনার্স এবং ২০১৮ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাংগুয়েজের জার্মান ভাষার শর্ট কোর্সে ভর্তি রয়েছেন তিনি।
আরেক সহ-সভাপতি মেহেদী হাসান মিশুও ড্রপ আউট হয়ে ছাত্রত্ব হারিয়েছেন। বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সিট বানিজ্য, দোকান ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে এক শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে ভয়ভীতি দেখিয়ে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পেছনে নাফিউল ইসলাম জীবন নামের এক শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে।
সহ-সভাপতি আলফাত সায়েম জেমস এর নামে হলকক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চুরি, বরাদ্দকৃত সিটে না থাকতে দেওয়া ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও তার নামে সিট বাণিজ্যেও অভিযোগ রয়েছে।
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী তাওহীদুল ইসলাম দূর্জয়। এই বিভাগ থেকে অনার্স শেষ করেছেন তিনি। কিন্তু ছাত্রত্ব ধরে রাখতে এখনো মাস্টার্স শেষ করেননি। তার বিরুদ্ধে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরোধী রাজনীতি করে সাংগঠনিক দুর্বলতা তৈরির অভিযোগ রয়েছে।
তামান্না আক্তার তন্নী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা প্রাচ্যকলা ও ছাঁপচিত্র বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী। তার মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষ হয়েছে ১৮ মাস আগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মিত শিক্ষার্থী হওয়ায় তাকে নিজের দখলে রাখা সিট ছাড়ার নির্দেশ দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রহমতুন্নেসা হলের গেটে তালা মেরে দেন এই ছাত্রলীগ নেত্রী।
অন্য আরেক সহ-সভাপতি মো. মোমিন ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন । তার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীকে পিটিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেয়া এবং হল থেকে বৈধ শিক্ষার্থীকে বের করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। তার নামে অর্থনীতি বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে রুমে ডেকে গলায় ছুরি ধরে কাছে থাকা আনুমানিক ২০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সাংবাদিকদের জানাতে চাইলে রড ও স্ট্যাম্প দিয়ে বেধড়ক মারধর করে। এতে ওই শিক্ষার্থীর কানের পর্দা ফেটে যায়। এরপরও এই বিষয়টি কাউকে জানালে আবরারের যে অবস্থা হয়েছে সেই অবস্থা হবে বলে হুমকি দেয়।
আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাইম আলীর নামে দলীয় কর্মসূচিতে না যাওয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) দুই শিক্ষার্থীর বিছানাপত্র নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও শিক্ষার্থী কৃষ্ণ রায়কে নির্যাতনের পর মেরে ‘শিবির’ বলে চালিয়ে দেওয়ার হুমকির ঘটনায় তদন্তে এই ছাত্রলীগ নেতার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির সভায় তার ছাত্রত্ব সাময়িক বাতিলের সুপারিশ করা হয়।
সাংগঠনিক সম্পাদক নাশরাত আর্শিয়ানা ঐশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের ২৮৮ নম্বর কক্ষে থাকতেন। তবে তার নামে ডাবল সিটের কক্ষে একা থাকাসহ রাজনৈতিক পাওয়ার দেখিয়ে হলের নিয়ম-নীতি না মানার অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় তার কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয় হল প্রশাসন।
এছাড়া নতুন ঘোষিত এ কমিটির বেশিরভাগই ছাত্রত্ব হারিয়ে এখন সান্ধ্যকালীন কোর্সধারী। সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নির্যাতন, দলীয় কোন্দল সহ নানা অভিযোগ রয়েছে তাদের নামে।
প্রসঙ্গত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২৬তম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় গত ১৮ সেপ্টেম্বর। এর আগে গত বছরের ২৩ অক্টোবর বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রাবি শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির জন্য জীবনবৃত্তান্ত আহŸান করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। প্রায় সপ্তাহ না যেতেই আরেক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১২ নভেম্বর সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় কমিটি। ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ছিল পদপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়ার শেষ সময়। শীর্ষ দুই পদের জন্য ৯৪ জন প্রার্থী জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন। যার মধ্যে সভাপতি পদে ২২ জন এবং সাধারণ সম্পাদক পদে ৭২ জন সিভি জমা দেন। এর আগে ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বরের ২৫তম সম্মেলনের মাধ্যমে শাখা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে গোলাম কিবরিয়া সভাপতি ও ফয়সাল আহমেদ রুনু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।