ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পেতে যাচ্ছে আনসার। ২০১৭ সালে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) সদর দপ্তর থেকে এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। প্রস্তাবে আইন সংশোধন করে আনসার বাহিনীকে ফৌজদারি অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়। পুলিশের আপত্তির মুখে প্রায় সাত বছর ওই প্রস্তাব আটকে ছিল। সম্প্রতি প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আনসার ও ভিডিপির একাধিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে এটি বিল আকারে উত্থাপন ও পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে আশাবাদী। তবে পুলিশ সদস্যদের অনেকেই মনে করেন, এটি দেশের জন্য ও তাদের বাহিনীর জন্য সুখকর হবে না। বর্তমানে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা পুলিশের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। সংশ্লিষ্ট কারও কারও মতে, আনসার বাহিনী যদি পুলিশের মতো হতে চায় তাহলে এই বাহিনীকে বিলোপ করে পুলিশের সঙ্গে মার্জ করে দেওয়া যেতে পারে।
ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতাসংক্রান্ত প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে আনসার ও ভিডিপির পরিচালক (অপারেশন) সৈয়দ ইফতেহার আলী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘২০১৭ সালের দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবটি পাঠানো হয়। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে বেশ কিছু শর্ত ও পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। সেগুলো সংশোধন ও সংযোজন করে আবার সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।'
তিনি বলেন, ‘কোনো আইন বা বিধি পাস হওয়ার আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে যায়। এই প্রস্তাবের ক্ষেত্রে সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। আনসারের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যতদূর জানি জাতীয় সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে প্রস্তাবটি বিল আকারে ওঠার কথা রয়েছে। সংসদে বিল পাস হওয়ার পর ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে আনসার ও ভিডিপি।’
আনসার ও ভিডিপির প্রস্তাবে বলা হয়, সরকার যেকোনো সময় যেকোনো অপরাধ তদন্ত করার জন্য আনসার ব্যাটালিয়নকে নির্দেশ দেবে। সরকারি নির্দেশ জারির পর আনসার ব্যাটালিয়ন কমান্ডিং অফিসাররা অপরাধ তদন্তের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। অপরাধ ও অপরাধসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের নির্দেশিত তথ্য সংগ্রহ করবেন। প্রাধিকারবিহীন অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক, সময়ে সময়ে সরকারের নির্দেশে এরূপ অন্যান্য যেকোনো বেআইনি বস্তু উদ্ধার করবেন।
সরকারের নির্দেশ মোতাবেক অপরাধের তদন্ত করবেন। জঙ্গি, নাশকতাকারী ও জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করতে পারবেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে জনপ্রশাসনকে সহায়তা করবেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবেন। সরকারের অর্পিত অন্য যেকোনো দায়িত্ব পালন করবেন।
আনসার বাহিনীর প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, আনসার ও ভিডিপি যুদ্ধকালীন আদেশ কাঠামোর নিয়ন্ত্রণে থেকে অভিযান চালাবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় ও অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রচলিত আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে। আইনের বিধান অনুযায়ী জননিরাপত্তা, অপরাধ প্রতিরোধ, শান্তিরক্ষা নিয়মিত বাহিনী গঠন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে, যা ‘আনসার ব্যাটালিয়ন বাহিনী’ নামে পরিচিত হবে। জননিরাপত্তা বিধান করে বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে সরকার এ আইনের আওতায় ‘বিশেষায়িত ইউনিট’ গঠন করতে পারবে। আনসার ব্যাটালিয়ন সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শৃঙ্খলা বাহিনী হবে।
অবকাঠামোগত বিষয়ে প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, “আনসার বাহিনীর জন্য সদর দপ্তর থাকবে ঢাকায়। এ ছাড়া ব্যাটালিয়নের জন্য পৃথক সদর দপ্তর হতে পারে। বিভাগীয় সদর দপ্তরে ‘রেঞ্জ সদর দপ্তর’ হবে বা প্রয়োজনে কোনো জেলায় বা কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রেঞ্জ সদর দপ্তর থাকতে পারে। সরকার নীতিমালা বা আইন প্রণয়ন করলে আনসার সদস্যরা অস্ত্র, গোলাবারুদ বহন ও ব্যবহার করতে পারবে।”
প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে আনসার ও ভিডিপির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সুশৃঙ্খল বাহিনী হচ্ছে আনসার। এই বাহিনীর সদস্যরা দেশের আনাচে-কানাচে, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় আছে। কোন এলাকায় কারা মাদক ব্যবসা করে, কারা আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি, কারা জঙ্গিসহ উগ্রবাদী তৎপরতায় জড়িত, কারা কালোবাজারি, চাঁদাবাজি বা বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িত সেই তথ্য এই বাহিনীর সদস্যরা সহজেই পেয়ে যাবে।
এর জন্য কোনো সোর্স নিয়োগ বা সোর্স মানিরও প্রয়োজন হবে না। ভিডিপি সদস্যদের মাধ্যমে আনসার অনায়াসে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আনসার ও ভিডিপি ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পেলে দেশের আইনশৃঙ্খলার রক্ষা সহজতর হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন যুগ্ম কমিশনার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আনসার বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পুলিশের প্যারালাল বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা পুলিশের জন্য বড় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয়। ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি ডিভিশন নামে পুলিশের আলাদা একটি ডিভিশন ও লোকবল থাকার পরও সরকার বিদেশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় আনসার নিয়োগ দিয়েছে। এখন তাদেরকে ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়ারও প্রক্রিয়া চলছে। পুলিশ বাহিনীর জন্য এটি সুখকর সিদ্ধান্ত হবে না। মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রচলিত আইনে আনসার ও ভিডিপি বাহিনী কাউকে গ্রেপ্তার বা মামলার তদন্ত করার এখতিয়ার রাখে না। তারা পুলিশের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। পুলিশের চাহিদার আলোকে বিভিন্ন ইউনিটের সঙ্গে সহযোগী ফোর্স হিসেবে মোতায়েন থাকে। তিনি আরও বলেন, ‘আনসার বাহিনী কোনো প্রস্তাব দিয়ে থাকলে সেটা পাস করা না করা সরকারের এখতিয়ার। আমার কাছে অফিসিয়ালি এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।’
আনসার বাহিনীর প্রস্তাব ও সেটা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে কঠোর সমালোচনা করে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এটি একটি অবাস্তব প্রস্তাব। আমি মনে করি সরকারকে ‘ডোবানোর জন্য’ কতিপয় ‘আঁতেল’ এসব প্রস্তাব দিচ্ছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়; সারা বিশ্বেই ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ পুলিশ (ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের মেজর কম্পোনেন্ট)। আদালত আর পুলিশের মাঝে থাকে প্রসিকিউশন। সিআরপিসি অনুযায়ী ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় একাধিক কর্তৃপক্ষ থাকে না। যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাইড লাইনে তারা থাকে সহযোগী শক্তি হিসেবে।
তদন্ত, উদ্ধার, গ্রেপ্তার এগুলো পুলিশেরই কাজ। আনসার এখন আর আনসার থাকতে চায় না, পুলিশ হতে চায়। তাদেরকে পুলিশের সঙ্গে মার্জ করে দিলেই হয়। অতীতে ‘সেক্রেটারিয়েট ক্যাডার ও ইকোনমিক ক্যাডার’ অ্যাডমিন ক্যাডারের সঙ্গে মার্জ হয়ে গেছে। আনসার বাহিনী ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমে পুলিশের প্যারালাল বাহিনী হবে এটার কোনো সুযোগ নেই। কিছু ব্যক্তি মাঝেমধ্যে উদ্ভট প্রস্তাব দিয়ে সরকারকে বিভ্রান্ত করছে। এখন আনসার তদন্ত ও গ্রেপ্তার ক্ষমতা চাচ্ছে; কিছুদিন পর বিজিবি চাইবে, অন্য সংস্থাও চাইবে; এটা হয় না। আনসার সহযোগী বাহিনী, তারা সহযোগী হিসেবেই থাকুক।
বিষয়টি নিয়ে পুলিশের ভেতর ক্ষোভ ও উদ্বেগ আছে উল্লেখ করে সাবেক এই পুলিশ প্রধান বলেন, ‘ভিভিআইপি প্রটেকশনে সব সময় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) থাকত; তাদের সঙ্গে থাকে পিজিআর ও এসএসএফ। এখন আনসার দেওয়া শুরু হয়েছে। বিষয়টি আমার বুঝে আসে না। আমি পুলিশের সাবেক প্রধান হিসেবে বলছি না; বাস্তবতা হচ্ছে- আনসার যদি পুলিশ হতে চায়; তাহলে আনসার বাহিনীকে বিলোপ করে পুলিশের সঙ্গে মার্জ করে দেওয়া হোক।’