অক্টোবরে রেমিট্যান্স বেড়েছে। এসেছে প্রায় ১৯৮ কোটি ডলার। যা আগের মাসের তুলনায় ৬৫ কোটি ডলার বেশি। সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৩৩ কোটি ডলার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বৃদ্ধি সাময়িক। বরং নতুন শঙ্কা ওমানে ভিসা স্থগিতের ঘটনা। বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য সব ধরনের ভিসা দেওয়া স্থগিত করেছে দেশটি। এতে ভবিষ্যতে দেশে প্রবাসী আয় কমার নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ যখন কমে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়ার ব্যাপারে ওমানের এই বিধিনিষেধের খবর এল। সেপ্টেম্বরে ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে প্রবাসী আয়ের অবদান কমে যাওয়া দেশের রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ।
ওমান থেকে পাওয়া খবরে বলা হয়, রয়্যাল ওমান পুলিশ (আরওপি) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হয়েছে। ওমানে ন্যাশনাল সেন্টার ফর স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড ইনফরমেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে প্রায় ১৫ লাখ বিদেশি বাস করেন, যাদের মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিরা সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি। এই সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের প্রবাসী আয়ের নবম বৃহত্তম উৎস ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান। ২০২১-২২ অর্থবছরে ওমান থেকে দেশে ৮৯ কোটি ৭৪ লাখ ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিমাণে কিছুটা কমলেও নবম স্থানেই ছিল ওমান। সেবার এসেছিল ৭৯ কোটি ডলার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাইয়ে দেশটি থেকে প্রবাসী আয় এসেছে ১২ কোটি ডলার; আগস্টে এসেছে ৬ কোটি ৪৭ লাখ ডলার আর সেপ্টেম্বরে এসেছে ৪ কোটি ২৪ লাখ ডলার। অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে ওমান থেকে দেশে প্রায় ২৩ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। যদিও পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, জুলাইয়ের পর প্রতি মাসেই সেখান থেকে প্রবাসী আয় আসা কমেছে; তারপরও প্রথম ৩ মাসে দেশটির স্থান পঞ্চম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, প্রবাসী আয়ের উদীয়মান বাজার ছিল ওমান। হঠাৎ ভিসা স্থগিতাদেশে সব এলোমেলো হয়ে যাবে। বিশেষ করে ভ্রমণ ভিসায় গিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের সংখ্যা জানা নেই। তবে তাদের ফেরত আসতে হবে। এছাড়া যারা যাওয়ার পথে তাদের যাওয়া আর হবে না। এতে ওমান থেকে প্রবাসী আয় আসা বিঘ্নিত হবে। যার প্রভাব পড়বে পুরো প্রবাসী আয়ের মধ্যে। সেজন্য এ সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এখানে কাজ করতে হবে। জানতে হবে কেন এমনটি করা হলো। সে আলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ওমানের এই ভিসা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রবাসী আয়ে প্রভাব ফেলবে। তবে তারা ঠিক কী কারণে এই সিদ্ধান্ত নিল, তা খতিয়ে দেখতে হবে। তারা কি সৌদি আরবের মতো নিজেদের মানুষ দিয়ে বেশি কাজ করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে, তা বোঝা দরকার। এরপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
প্রবাসী আয়ে প্রতি ডলারের বিপরীতে এখন ১১৫ টাকা পর্যন্ত দেওয়া যাচ্ছে। ফলে সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ে বড় পতন দেখা গেলেও অক্টোবরে তা কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ কোটি ৭৬ লাখ মার্কিন ডলার। এরমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ১৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার, বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ কোটি ৮২ লাখ ডলার, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ১৭৫ কোটি ৮৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৬০ লাখ মার্কিন ডলার।
অন্যদিকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাস রেমিট্যান্স প্রবাহ ধারাবাহিকভাবে কমেছিল। ডলার সংকটের কারণে সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয়ে বড় হোঁচট খায়। ওই মাসে প্রবাসী আয় আসে ১৩৩ কোটি ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার এবং আগস্টে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। পরে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় এবিবি ও বাফেদার ওপর। এরপর থেকেই সংগঠন দুটি মিলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে এই দুই সংগঠন।
বর্তমানে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ৫০ পয়সা বাড়িয়ে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। ১ নভেম্বর থেকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানিকারকদের থেকে প্রতি ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় কিনে আমদানিকারকদের কাছে ১১১ টাকায় বিক্রি করবে ব্যাংকগুলো। আন্তঃব্যাংকে ডলারের সর্বোচ্চ দর হবে ১১৪ টাকা। এতদিন ১১০ টাকায় ডলার কিনে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রির সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু নভেম্বরে শ্রমিকরা ওমানে যেতে না পারলে প্রবাসী আয়ের প্রবাহে আবার ছেদ পড়তে পারে বলেই আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।