কোরবানির পশুর হাট টার্গেট করে জাল টাকা ছড়াতে সক্রিয় বিভিন্ন চক্র। ফেসবুকে পেজ খুলে জাল টাকা বেচাকেনার প্রচারণা চালানো হচ্ছে প্রকাশ্যে। দেওয়া হচ্ছে হোম ডেলিভারি। চক্রটির প্রধান টার্গেট পশুর হাট। এসব চক্রের রয়েছে বিভিন্ন এজেন্ট। তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বাজারে। নামমাত্র খরচে জাল টাকা বানিয়ে একবার বাজারে ছেড়ে দিতে পারলেই চক্রটির পকেটে ঢোকে মোটা অংকের টাকা।
ঈদের আগে এমন একাধিক জাল টাকার কারবারি চক্রের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে পশুর হাটে যেন জাল টাকা না ছড়াতে পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও প্রস্তুত। হাটে জাল টাকা শনাক্তের মেশিন বসানোসহ থাকছে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঈদুল আজহা টার্গেট করেই বাজারে ছাড়া হয়েছে লাখ লাখ টাকার জাল নোট। আরও নোট ছাড়তে রাজধানীতে সক্রিয় অর্ধশতাধিক চক্র। তারা ১০০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকার নোট জাল করে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। চলতি বছর প্রায় পৌনে এক কোটি জাল টাকা উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
রাজধানীর পশুর হাটগুলো এরই মধ্যে বসে গেছে। শুরু হয়েছে কেনাবেচা। ব্যাপারীরা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আনছেন পশু। হাটগুলোতে প্রতিদিন লেনদেন হবে কোটি কোটি টাকা। তাই পশুর হাট টার্গেট করে জাল টাকা সরবরাহের পাঁয়তারা করছে চক্রগুলো।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, জাল নোটগুলো খুবই নিখুঁতভাবে তৈরি করা হচ্ছে। একটু অসতর্ক হলেই এগুলো আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে প্রত্যেক গরুর হাটে জাল টাকা রোধে একাধিক বুথ বসাবে পুলিশ।
গত ১৯ জুন রাতে রাজধানীর উত্তরখান থানা এলাকা থেকে দুই লাখ টাকার জাল নোট ও চক্রের মূলহোতাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে র্যাব-৩। চক্রটির টার্গেট ছিল ঈদে পশুর হাটে জাল নোট ছড়িয়ে দেওয়া। চক্রের মূলহোতা মো. মেহেদী হাসান ফটোশপ এবং গ্রাফিক্সের কাজ জানতেন। এরপর ইউটিউব দেখে শেখেন জাল টাকা বানানোর প্রক্রিয়া। ফেসবুকের মাধ্যমে গ্রেফতার শাহজাদা ও তুষারের সহযোগিতায় জাল টাকা তৈরি করে কেনাবেচা শুরু করেন। পাঁচ-ছয় লাখ টাকার চালানসহ চারটি চালান দেন তারা। মাত্র দুই হাজার টাকা খরচ করে তৈরি করেন এক লাখ টাকার জাল নোট।
গত ২১ জুন রাজধানীর মুগদার দক্ষিণ মান্ডায় তিন লাখ ৩৮ হাজার টাকার জাল নোটসহ দুজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এসব টাকা কোরবানির পশুর হাটে সরবরাহের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। চক্রটির টার্গেট ছিল বিপুল পরিমাণ জাল নোট তৈরির। তবে তার আগেই তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয় র্যাব।
গত ২৩ জুন গাজীপুর মহানগর সদর থানা এলাকা থেকে আসল টাকার ভিড়ে জাল নোট প্রবেশ করানো একটি চক্রের এক সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব-১। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে জাল টাকা সংগ্রহ ও বিক্রির জন্য সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আসছিল। অনলাইনে বিজ্ঞাপন ও ভিডিও দেখিয়ে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করা হতো। এছাড়া চক্রটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা আদান-প্রদান করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে জাল টাকা খুচরা বিক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতো। এমনকি আসল টাকার বান্ডিলের ভেতরও জাল টাকা ঢুকিয়ে দিতো চক্রটি।
পুলিশ ও র্যাবের কয়েকটি অভিযানে দেখা যায়, আগে সাধারণত ৫০০ ও ১০০০ টাকার জাল নোট ছাপাতো চক্রগুলো। তবে মানুষ এসব নোট লেনদেনের ক্ষেত্রে অধিক সতর্ক থাকায় ৫০/১০০/২০০ টাকার নোটও জাল করছে। এসব জাল টাকা অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমেও বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও জাল নোট সরবরাহ করার নজির রয়েছে। এসব চক্র এক লাখ জাল টাকা ১০-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে।
ডিএমপির তথ্য বলছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে ১২ হাজার ৭৫৯টি জাল নোট উদ্ধার করেছে। এসব জাল নোটের মূল্যমান ৭৫ লাখ ৮৮ হাজার ৪১০ টাকা। এই সময়ে জাল টাকা ছাড়াও তা তৈরির বিপুল পরিমাণ যন্ত্রপাতিও জব্দ করা হয়। এই পাঁচ মাসে জাল নোট সংক্রান্ত সবগুলো মামলাই তদন্তাধীন। জাল টাকা ছাড়া বিদেশি জাল মুদ্রাও তৈরি করছে চক্রগুলো। গত এপ্রিলে ১২ লাখ টাকার জাল রুপিও জব্দ করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
রাজধানীর প্রতিটি পশুর হাটে জাল নোট শনাক্তের মেশিন ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২১ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা সব তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়, রাজধানীর দক্ষিণ সিটির ১০টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের ৯টি পশুর হাটে জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ স্থাপন করতে হবে। একই সঙ্গে দেশের অনুমোদিত অন্য কোরবানি পশুর হাটগুলোতে (উপজেলা সদর পর্যন্ত) জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ স্থাপন করতে হবে। হাট শুরুর দিন থেকে ঈদের আগের রাত পর্যন্ত পশু ব্যবসায়ীদের বিনামূল্যে এ সেবা দেবে ব্যাংকগুলো।
ঢাকার বাইরে যেসব জেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিস রয়েছে সেখানে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা অনুমোদিত পশুর হাটগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট অফিসের নেতৃত্বে একই ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার জন্য আঞ্চলিক কার্যালয়কে নির্দেশনা দিতে হবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিস নেই এমন জেলাগুলোর সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, থানা বা উপজেলার অনুমোদিত পশুর হাটে বিভিন্ন ব্যাংকের দায়িত্ব বণ্টনের জন্য সোনালী ব্যাংকের শাখাগুলোকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
গাবতলী পশুর হাটে জাল টাকার নোট শনাক্তের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) জসীম উদ্দিন মোল্লা বলেন, হাটে জাল নোট শনাক্তে মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। যে কেউ এ মেশিনে নোট আসল না জাল তা শনাক্ত করতে পারবেন। এছাড়া পুলিশের কন্ট্রোলরুম ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে গাবতলী হাটে।
যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনায় পুলিশের সহায়তা নেওয়ার জন্যও ব্যাপারী, ক্রেতা-বিক্রেতা ও সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানান তিনি। এছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ এ ফোন করেও তাৎক্ষণিক পুলিশি সেবা পাওয়া যাবে।
ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, যে কোনো বড় উৎসব টার্গেট করে জাল নোট কারবারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। সারা বছর যে পরিমাণ জাল টাকা তারা বিক্রি করতে না পারে এসব উৎসবে তার দ্বিগুণ বিক্রি করে। প্রতি বছরই ঈদের মাসখানেক আগে থেকেই এসব চক্র প্রস্তুতি শুরু করে। দিন-রাত কাজ করে তারা জাল নোট তৈরি করে।
‘এসব জাল নোট তারা পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা আবার সেটি বাড়তি মূল্যে খুচরা ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে। খুচরা ব্যবসায়ীরা জাল নোট বিভিন্ন কৌশলে বাজারে ছাড়ে। তবে আসন্ন ঈদুল আজহা ঘিরে জাল নোট চক্রের সদস্যরা যেমন সক্রিয়, তেমনি ডিএমপির প্রতিটি থানা ও ডিবির প্রত্যেক ইউনিটের সদস্যরাও তাদের ধরার জন্য তৎপর। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রুপকে আইনের আওতায় আনা গেছে। পশুর হাটেও জাল নোট শনাক্তে মেশিন থাকবে। সেখানে আসল-নকল চিহ্নিত করা যাবে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজধানীসহ সারাদেশে হাটকেন্দ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে র্যাব। পশুর হাটে নগদ টাকার লেনদেন হয়। সেখানে বিভিন্ন ব্যাংকের অস্থায়ী বুথের নিরাপত্তায় সহযোগিতা করবে র্যাব। হাটে অজ্ঞান ও মলমপার্টির সদস্যরা সক্রিয় থাকে, হাট কেন্দ্র করে এ ধরনের কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে সে বিষয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ওয়াচ টাওয়ার ও অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়েছে রাজধানীর বড় হাটে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (গোয়েন্দা) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ঈদ টার্গেট করে জাল নোট প্রতিরোধে ডিবির গোয়েন্দারা মাঠে কাজ করছেন। এর আগে একাধিক চক্রের সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা জামিনে আছেন তাদেরও নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
জাল নোটের কোনো তথ্য পেলে ডিবিকে জানানোর অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, ঈদের আগে কেউ যদি বড় ধরনের লেনদেন করতে চান তাহলে তিনি পুলিশের সহযোগিতা নেবেন। ডিএমপির তথ্য সংগ্রহ বিভাগ, গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ ও সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্য পশুর হাটের নিরাপত্তা, জাল টাকা প্রতিরোধ ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যসহ সব ধরনের অপরাধ নির্মূলে কাজ করছে।
এক. ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকাসহ প্রত্যেক নোটের সামনে ও পেছন দুদিকের ডিজাইন, মধ্যভাগের লেখা, নোটের মূল্যমান এবং সাতটি সমান্তরাল সরল রেখা উঁচু-নিচুভাবে মুদ্রিত থাকে। ফলে হাত দিলে একটু খসখসে মনে হয়।
দুই. নোটের ডানদিকে ১০০ টাকার ক্ষেত্রে তিনটি, ৫০০ টাকার ক্ষেত্রে চারটি ও এক হাজার টাকার নোটে পাঁচটি ছোট বৃত্তাকার ছাপ আছে, যা হাতের স্পর্শে উঁচু-নিচু লাগে। এ বৈশিষ্ট্য জাল নোটে সংযোজন করা সম্ভব নয়।
তিন. জাল নোটের জলছাপ অস্পষ্ট ও নিম্নমানের হয়। আসল নোটে ‘বাঘের মাথা’ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রামের স্পষ্ট জলছাপ আছে, যা ভালো করে খেয়াল করলে আলোর বিপরীতে দেখা যায়।
চার. প্রত্যেক মূল্যমানের নোটেই বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো সম্বলিত নিরাপত্তা সুতা থাকে। নোটের মূল্যমান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো নিরাপত্তা সুতার চারটি স্থানে মুদ্রিত থাকে।
এ নিরাপত্তা সুতা অনেক মজবুত, যা নোটের কাগজের সঙ্গে এমনভাবে সেঁটে দেওয়া থাকে যে নখের আঁচড়ে বা মুচড়িয়ে সুতা কোনোভাবেই তোলা সম্ভব নয়। নকল নোটে এত নিখুঁতভাবে সুতাটি দিতে পারে না।
পাঁচ. ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের প্রত্যেক প্রকার নোটের ওপরের ডান দিকে কোণায় ইংরেজি সংখ্যায় লেখা নোটের মূল্যমান রং পরিবর্তনশীল কালিতে মুদ্রিত থাকে। ফলে ১০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোট ধীরে ধীরে নড়াচড়া করলে মূল্যমান লেখাটি সোনালি থেকে সবুজ রং ধারণ করে। একইভাবে ৫০০ লেখা লালচে থেকে সবুজাভ হয়। অন্যদিকে জাল নোটে ব্যবহৃত রং চকচক করলেও তা পরিবর্তন হয় না।
ছয়. প্রত্যেক প্রকার টাকার নোটে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম ও নোটের মূল্যমান জলছাপ হিসেবে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম ও নোটের মূল্যমান প্রতিকৃতির তুলনায় উজ্জ্বল দেখায়। জাল নোটে এসব বৈশিষ্ট্য থাকে না।
ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে জাল নোট সহজেই পরীক্ষা করা যায়। জাল নোট ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখলে শুধু একটা রেখা দেখা যাবে।