ফ্লোর প্রাইস (দাম কমার নিম্নসীমা) প্রত্যাহারের পর শেয়ারবাজারে টানা পতন চলছে। গত এক সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
এ সময়ে মূল্যসূচক কমেছে ১৮০ পয়েন্ট। আলোচ্য সময়ে কোনো কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম ৪০ শতাংশের বেশি কমেছে। তবে সামগ্রিকভাবে বাজারের মোট লেনদেন ৩৩ শতাংশ বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই বিনিয়োগকারীদের দিক থেকে শেয়ার বিক্রির চাপ রয়েছে। এরপর ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের পক্ষ থেকে মার্জিন ঋণের বিপরীতে ফোর্সড সেল (বাধ্যতামূলক শেয়ার বিক্রি) শুরু করলে বাজার অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
আর এ ধরনের পরিস্থিতি সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার জন্য বিব্রতকর হবে। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার একটি সূত্র মনে করছে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।
প্রসঙ্গত ফ্লোর প্রাইস হলো শেয়ার দাম কমার নিম্নসীমা। করোনার সময় অস্থিরতা ঠেকাতে নতুন এই নিয়ম চালু করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
এক্ষেত্রে কোনো কোম্পানির শেয়ারের দামের ভিত্তি হবে ‘আগের ৫ দিনের সর্বশেষ লেনদেনের (ক্লোজিং প্রাইস) গড় দর।’ কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসের নিচে নামতে পারবে না। কিন্তু স্বাভাবিক সার্কিট ব্রেকার (একদিনে দাম ওঠানামার সীমা) অনুসারে দাম ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারবে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রথমবার ২০২০ সালে মার্চে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করলেও ২০২১ সালের জুলাইয়ে তুলে নেওয়া হয়। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দরপতন ঠেকাতে গত ২০২২ সালের ২৮ জুলাই পুঁজিবাজারের দ্বিতীয়বারের মতো ফ্লোর প্রাইস দেয় বিএসইসি। গত সপ্তাহে ১২টি কোম্পানি বাদে বাকি সবগুলোর ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হয়। এরপর এক সপ্তাহে বাজারে ব্যাপক উত্থান-পতন হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফ্লোর তুলে নেওয়া হলে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হবে বাজারে এ ধরনের আতঙ্ক ছিল। পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউজ, প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন সিইও ফোরাম এবং ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের এক ধরনের প্রস্তুতি ছিল। তারা বাজারে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট একটি অঙ্কের তহবিল জোগাড় করেছিল।
কিন্তু দীর্ঘদিন আটকে থাকা এই বাজারের জন্য ওই তহবিল যথেষ্ট নয়। রোববার ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পর প্রথম তিন দিন সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। ফলে ইতোমধ্যে তহবিলের বড় অংশ সাপোর্টে ব্যয় হয়েছে। শেষের দুই দিন সেভাবে সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে সূচকের বড় পতন হয়েছে।
এদিকে মার্চেন্ট ও ব্রোকারেজ হাউজের বড় অংশের টাকা বর্তমানে মার্জিন ঋণে আটকে আছে। তারা ফোর্সড সেল শুরু করলে বাজারের জন্য অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করবে। তবে সূত্রটির মতে, বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম যে স্তরে রয়েছে, তা স্বাভাবিকের চেয়ে মোটেই বেশি নয়। ফলে সূচক কিছুটা কমলেও দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াবে।
এছাড়া বড় মূলধনের ১২টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস এখনো তোলা হয়নি। এই কোম্পানি থেকে ফ্লোর তুলে নেওয়া হলে আরও বড় চাপ আসবে। এটির জন্য বড় প্রস্তুতি দরকার।
গত সপ্তাহে ৫ দিনে ডিএসইতে ৪ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৯৭০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। আগের সপ্তাহে ৫ দিনে ৩ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল।
প্রতিদিন গড়ে ৭২৭ কোটি টাকা হয়েছিল। এ হিসাবে গত সপ্তাহে লেনদেন বেড়েছে ১ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। প্রতিদিন গড়ে লেনদেন বেড়েছে ২৪৩ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে যা ৩৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ডিএসই ব্রড সূচক ১৮০ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ১৫৬ পয়েন্টে নেমে এসেছে।
ডিএসই-৩০ সূচক দশমিক ১৫ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ১১৪ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ডিএসই শরীয়াহ সূচক ৩৬ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৩৮৮ পয়েন্টে নেমে এসেছে। গত সপ্তাহে ৪০৭টি কোম্পানি লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ৭৪টি কোম্পানির শেয়ারের, কমেছে ৩০৮টি এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৪টি কোম্পানির শেয়ারের দাম। তবে ১১টি কোম্পানির কোনো শেয়ার লেনদেন হয়নি।
গত সপ্তাহের শুরুতে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। সপ্তাহ শেষে তা কমে ৭ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এ হিসাবে বাজার মূলধন ৩৩ হাজার কোটি টাকা কমেছে।
একক কোম্পানি হিসাবে গত সপ্তাহে বিডি থাই অ্যালুমিনিয়াম ও জিএসপি ফাইন্যান্সের শেয়ারের দাম ৪০ দশমিক ৬০ শতাংশ কমেছে। এছাড়া বেলিজিংয়ের শেয়ারের দাম কমেছে ৩৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ, এমএল ডাইং ৩৮ দশমিক ৭১, মতিন স্পিনিং ৩৮ দশমিক ৪০, আইপিডিসি ৩৮ দশমিক ০২, রিং শাইন টেক্সটাইল ৩৭ দশমিক ৭৬ এবং ম্যাকসন্স স্পিনিংয়ের শেয়ারের দাম ৩৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ কমেছে।
গত সপ্তাহে ডিএসইতে শীর্ষ দশের তালিকায় থাকা কোম্পানিগুলোতে ৯৯৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। যা বাজারের মোট লেনদেনের ২০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম অবস্থানে থাকা বিডি থাই অ্যালুমিনিয়ামের লেনদেন ১৩৮ কোটি টাকা, ওরিয়ন ইনফিউশন ১৩১ কোটি, ফরচুন সুজ ১১৫ কোটি, ফুয়াং ফুড ৯৮ কোটি, দেশবন্ধু পলিমার ৯৭ কোটি, কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স ৯৪ কোটি, লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ ৮২ কোটি, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ৮০ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংক ৮০ কোটি এবং সীপার্ল বীসের ৭৭ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।