মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর এবং জ্বালাও-পোড়াও থেকে সরে এসেছে গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়ার বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। দেড় সপ্তাহ পর গতকাল রোববার তারা কারখানায় গিয়ে কাজ শুরু করে। এর মধ্য দিয়ে আবার কর্মমুখর হয়ে উঠেছে গাজীপুর ও আশুলিয়ার পোশাক কারখানা।
এদিকে আশুলিয়ায় গত কয়েক দিনে একাধিক কারখানা ভাঙচুরের ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি দেড় হাজার।
পুলিশ জানায়, বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ কর্মসূচির মধ্যেই গতকাল গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ দেয়। সড়কে যানবাহন না পেয়ে অনেকে হেঁটে কর্মস্থলে পৌঁছে। তবে কোনাবাড়ীর মণ্ডল গ্রুপ ও ইসলাম গ্রুপের দুটি কারখানার শ্রমিক কাজ করেনি। তারা কারখানায় ঢুকলেও দুপুর পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করে বেরিয়ে যায়। গতকালও গাজীপুরের মোড়ে মোড়ে বিপুলসংখ্যক বিজিবি ও পুলিশ সদস্যকে টহল দিতে দেখা যায়। কারখানা কর্তৃপক্ষও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে শ্রম প্রতিন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান নতুন মজুরি ঘোষণার জন্য ৪ দিন সময় নিয়েছেন। নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণে তিনি নিম্নতম মজুরি বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন। ওই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে শ্রমিকরা আন্দোলন স্থগিত রেখে কাজে ফিরেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘২৩ হাজার টাকা মাসিক মজুরি ও দ্রুত নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণার দাবিতে শ্রমিকরা আন্দোলনে আছে। দাবি দুটি পূরণ হলে তারা কাজ না করে বসে থাকবে না। পোশাক শিল্পের ক্ষতি শ্রমিকরা চায় না।’
গাজীপুরের শতাধিক পোশাক কারখানার শ্রমিক মাসিক মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে গত ৯ দিন ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে জ্বালাও-পোড়াও করে। এ সময় অর্ধশতাধিক কারখানায় হামলা চালিয়ে তারা ভাঙচুর করে। একটি পুলিশ বক্স ও দুটি কারখানায় আগুন দেয়।
পোশাক শ্রমিক জাহাঙ্গীর কবীর, বকুল মিয়া, সুলতানা বেগম, নাছিমা বেগম ও আকরাম হোসেন জানান, তারা বেতন বাড়ানোর দাবিতে মহাসড়কে অবস্থান নিলেও কোনো কারখানা ভাঙচুর করেননি।
কারখানা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে কিছু বহিরাগত।
কালিয়াকৈর উপজেলার নীজ ফ্যাশন, লগোজ নিট ওয়্যার, গোমতি টেক্সটাইল অ্যান্ড নিট ওয়্যার, এপেক্স ল্যান্ডজারি লিমিটেড, এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডসহ সব কারখানায় গতকাল শ্রমিকদের কাজ করতে দেখা যায়। কয়েকজন শ্রমিক বলে, তারা যে বেতন পায়, তা দিয়ে সংসার চলে না। ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ এবং চাল কিনতেই টাকা শেষ হয়ে যায়। তাই বেতন বাড়ানোর দাবি তুলেছে তারা।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২ এর সুপার সারোয়ার আলম বলেন, ‘শ্রমিকরা বেশ কয়েক দিন গাজীপুর অশান্ত করে রেখেছিল। গতকাল তারা কাজে যোগ দিয়েছে। গাজীপুরের অন্তত আড়াই হাজার পোশাক কারখানা আবার কর্মমুখর হয়ে উঠেছে।’
আশুলিয়ায় সকালেই কাজে যোগ দেয় শ্রমিকরা
কয়েক দিনের আন্দোলন থেকে সরে এসে সাভারের আশুলিয়ার পোশাক শ্রমিকরা গতকাল কাজে যোগ দিয়েছে। এতে আবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে কারখানাগুলো। কোথাও শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেনি। তবে বিভিন্ন কারখানার সামনে ছিল অতিরিক্ত পুলিশ।
আশুলিয়ার জামগড়া, ছয়তলা ও নরসিংহপুরের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় সকাল ৮টার মধ্যে দল বেঁধে শ্রমিকরা প্রবেশ করে। শ্রমিকরা জানায়, তাদের ন্যূনতম মজুরি কত হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তাই কাজে না গিয়ে গত কয়েক দিন তারা সড়কে আন্দোলন করেছে। তাদের দাবি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনায় যৌক্তিক মজুরি কাঠামো দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। পোশাক কারখানায় যেন আর কোনো ঝামেলা না হয়।
পোশাক শ্রমিক শারমিন আক্তার বলেন, ‘জিনিসপত্রের অনেক দাম। জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে উঠেছে। আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না। ভালোভাবে কারখানায় কাজ করে বাসায় ফিরতে চাই। শুধু সরকার যেন দ্রুত আমাদের বেতন বাড়ায়।’
স্থানীয় শ্রমিক নেতা মো. ইব্রাহিম বলেন, ‘শিল্পাঞ্চলের পরিবেশ এখন শান্ত; কোনো আন্দোলন নেই। শ্রমিকরা কাজে ফিরেছে। আশা করি, আর কোনো আন্দোলন হবে না।’
শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (ইন্টেলিজেন্স) মোহাম্মদ আজাদ মিয়া বলেন, ‘শ্রমিক ভাই-বোনরা স্বতঃস্ফূর্ত কাজে যোগদান করেছে। শিল্পাঞ্চল এখন শান্ত। তারা বুঝতে পেরেছে– তাদের ভুল বোঝানো হয়েছিল।’ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন রয়েছে বলে জানান তিনি।
তিন মামলায় আসামি দেড় হাজার
পোশাক কারখানা ভাঙচুরের ঘটনায় আশুলিয়া থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। পুলিশ বলছে, শনিবার রাতে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা কর্তৃপক্ষ মামলা তিনটি করে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাত দেড় হাজার ব্যক্তিকে।
মজুরি বাড়ানোর আন্দোলনের সময় আশুলিয়ার কাঠগড়া এলাকার ছেইন এ্যাপারেলস লিমিটেড, বেরন সরকার মার্কেট এলাকার হা-মীম গ্রুপের নেক্সট কালেকশন্স লিমিটেড ও ধনাইদ ইউসুফ মার্কেট এলাকার ডিসাং সোয়েটার লিমিটেডে ভাংচুরের ঘটনা ঘটে।
মামলার এজাহারসূত্রে জানা যায়, গত ৩১ অক্টোবর সকাল ১১টার দিকে কাঠগড়ার ছেইন এ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানায় ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিক ও বহিরাগতরা। এ ঘটনায় মামলা করেন কারখানার ডিজিএম (অপারেশন) মো. আনিসুর রহমান। এতে আসামি করা হয় অজ্ঞাত ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে। একই দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ডিসাং সোয়েটার কারখানায় ভাঙচুরের ঘটনায় আরেকটি মামলা হয়। এতে আসামি করা হয় অজ্ঞাত ৩০০ থেকে ৪০০ ব্যক্তিকে।
এ ছাড়া হা-মীম গ্রুপের নেক্সট কালেকশন্স লিমিটেড কারখানায় গত ৩০ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে আহত হন কারখানার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাসহ কয়েকজন। এ ঘটনায় হওয়া মামলায় আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাত ৫০০ থেকে ৬০০ ব্যক্তিকে। নেক্সট কালেকশন্স লিমিটেডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. ফরহাদ উদ্দিন থানায় মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এসব মামলার বিষয়ে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘কারখানা ভাঙচুরের ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। কারা কারখানা ভাঙচুর করেছে বা কারা জড়িত ছিল, তা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’