২৪ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ০৮:০৯:৩০ পূর্বাহ্ন
আল শিফা হাসপাতালে মৃত্যুর সময়ও পানি পাচ্ছে না রোগীরা
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-১১-২০২৩
আল শিফা হাসপাতালে মৃত্যুর সময়ও পানি পাচ্ছে না রোগীরা

‘আমাদের এখানে কিছুই নেই, শক্তি নেই, খাবার নেই, পানি নেই। প্রতি মুহূর্তে এখানে মৃত্যু হচ্ছে। গত রাতে ২২ জন মারা গেছেন। তিন দিন ধরে হাসপাতাল অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এটি এখন বড় কারাগার আর গোরস্তান ছাড়া কিছুই না।’ গাজার প্রধান হাসপাতাল আল-শিফার পরিচালক মুহাম্মেদ আবু সালমিয়া সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে এসব কথা বলেছেন।


হামাস-ইসরায়েলের মধ্যে চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাতে গত বুধবার আল-শিফা কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে ইসরায়েলি সেনারা। গতকাল তৃতীয় দিনের মতো ঝটিকা তল্লাশি করেছে তারা। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) দাবি করেছে, আল-শিফার কাছাকাছি এলাকা থেকে হামাসের কাছে থাকা দুই জিম্মির মরদেহ উদ্ধার করেছে তারা। তাদের একজন ৬৫ বছর বয়সী ক্যানসার আক্রান্ত ইহুদিত ওয়েইস এবং ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য নোয়া মার্সিয়ানো।


মার্সিয়ানোর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু অস্ত্র, ল্যাপটপ উদ্ধার করে আইডিএফ দাবি করেছে, তারা হামাসের টানেল খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসক এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এখন পর্যন্ত ইসরায়েল শক্ত প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। বরং কয়েকটি ভিডিও প্রচার করেছে আইডিএফ যেগুলোকে হামাস বলছে, কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে।


এদিকে আল-শিফার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। হাসপাতালটির একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, পানির লাইনে বোমা ফেলায় হাসপাতালের পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে রোগীসহ সেখানে আশ্রয় নেওয়া কয়েক হাজার মানুষ মারাত্মক পানি কষ্টে ভুগছেন। ইসরায়েলি তা-বের ফলে হাসপাতালটির সেবা কার্যক্রম অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন পানি ও খাদ্যের অভাবে চিকিৎসকসহ সেখানকার কয়েক হাজার মানুষ মৃত্যুর মুখে রয়েছে। হাসপাতালের রোগীরা পর্যন্ত পানি পাচ্ছেন না। অনেকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করছেন।


এদিকে আল-শিফার পরিচালক জানিয়েছেন, এখনো সেখানে ৭ হাজার মানুষ অবস্থান করছে; তারা খাবার, পানি, ওষুধের তীব্র সংকটে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল-কুদরা বলেছেন, হাজারো নারী-শিশু, অসুস্থ এবং আহতরা মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক আইনজীবীরা বলছেন, আল-শিফা হাসপাতালে ইসরায়েল যা করছে তা অবশ্যই যুদ্ধাপরাধ। এ ছাড়া গোটা গাজায় যা হচ্ছে তা গণহত্যা। আল-শিফায় ইসরায়েলি কর্মকা-ের আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছে অনেক সংস্থা।


এদিকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তথ্য লোপাট এবং ভুয়া তথ্য পরিবেশনের অভিযোগ রয়েছে। ইসরায়েল বলেছিল, আল-শিফায় নবজাতকদের বাঁচাতে তারা ইনকিউবেটর সরবরাহ করেছে কিন্তু হাসপাতালটির পরিচালক বলেছেন এটি সত্য নয়। তিনি বলেছেন, হাসপাতালে ইনকিউবেটরের প্রয়োজন নেই, আমাদের প্রয়োজন অক্সিজেন এবং সে জন্য প্রয়োজন জ্বালানি। সেটি তারা দেয়নি। এ ছাড়া আল-শিফার বার্ন ইউনিটের প্রধান জানিয়েছে, অভিযানের সময় ইসরায়েলি সেনারা অনেক মরদেহ সরিয়েছে।


শুধু আল-শিফাই নয়, গাজার আরও বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘিরে রেখেছে ইসরায়েলি সেনারা। আল-আহলি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আবু ঘাসান সিত্তা বলেছেন, ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক হাসপাতালের চারদিকে অবস্থান নিয়েছে। এখানে ৫০০ আহত রোগীর চিকিৎসা চলছে। এই হাসপাতালেও চিকিৎসা সরঞ্জাম শেষ হওয়ায় সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এমন অসহায় পরিস্থিতিতে আমাকে কখনোই পড়তে হয়নি। এছাড়া দখলকৃত পশ্চিম তীরে সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ইবনে সিনা হাসপাতালেও ইসরায়েলি সেনারা ঝটিকা আক্রমণ চালিয়েছে।


এ সময় সেখানকার চিকিৎসকদের হাত ওপরে তুলে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয় সেনারা। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। জেনিন শরণার্থী শিবিরের কাছে ওই হাসপাতালটিতে অভিযানের সময় ১৪ জন আহত হয়েছেন। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, গাজায় তার অর্থায়নে তৈরি স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) এ কথা বলেন তিনি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে ছিল।


ইসরায়েলি হামলার টার্গেট থেকে কিছুই বাদ পড়ছে না। গতকালও জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে বিমানহামলায় ১৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে আল জাজিরার জানিয়েছে, দক্ষিণ গাজার জয়তুন শহরে আল-ফালাহ স্কুলে গতকাল বিমানহামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে বেশ কয়েজন নিহত এবং শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। এ ছাড়া গতকাল পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, চলমান সংঘাতে শুধু পশ্চিম তীরে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়েছে। গতকাল দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসেও বিমানহামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।


ইসরায়েল এতদিন বলে আসছিল, তারা শুধু হামাসকে টার্গেট করছে এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলা করছে। কিন্তু গতকাল ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্বীকার করেছেন, সাধারণ মানুষের প্রাণহানি কমিয়ে আনতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তবে তিনি এর দায়ও চাপিয়েছেন হামাসের ওপর।


উল্লেখ্য, ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া চলমান সংঘাতে সাড়ে ১১ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন- যার অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। গতকাল গাজায় আবারও ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের অনুমোদন বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ বলছে, ফোন যোগাযোগ ও জ্বালানি ছাড়া সেখানে কার্যক্রম চালু রাখা অসম্ভব। যদিও ইসরায়েল বলছে, তারা দিনে দুই ট্রাক তেল সরবরাহের অনুমোদন দিয়েছে। তবে সেটি যেন কোনোভাবেই হামাসের কাছে না যায়।


শেয়ার করুন