২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৫:০০:২৬ অপরাহ্ন
বিশেষ তদারকিতে বাংলাদেশ ব্যাংক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-১১-২০২৩
বিশেষ তদারকিতে বাংলাদেশ ব্যাংক

ডলার সরবরাহের ঘাটতির কারণে টাকার অবমূল্যায়ন থামানো যাচ্ছে না। ডলার সঙ্কট দিন দিন বেড়েই চলছে। এমনি পরিস্থিতিতে মুদ্রাপাচার ঠেকাতে ও ডলার সরবরাহ বাড়ানোর জন্য আমদানি ব্যয়ের পাশাপাশি রফতানি আয়ের ক্ষেত্রেও বিশেষ তদারকিতে নেমেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্ডার ইনভয়েজিংয়ের মাধ্যমে অর্থাৎ পণ্য মূল্য কম দেখিয়ে রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার করা হচ্ছে কি না তা তদারকি করা হচ্ছে। পাশাপাশি যে পরিমাণ পণ্য বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে সমপরিমাণ অর্থ দেশে ফিরে আসছে কি না তাও তদারকি করা হচ্ছে। এজন্য ৫০ হাজার ডলারের ওপরে কেউ রফতানি করলেই ওই তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হচ্ছে। আর আমদানিতে তিন লাখ ডলারের পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা হলেই তার তথ্য জানাতে হচ্ছে।


সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বেশি মূল্যের পণ্য কম মূল্য দেখিয়ে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। যেমন, একটি টি-শার্টের মূল্য যেখানে ২০০ টাকা, সেখানে দেখানো হয়েছে ৩০ টাকা। এভাবে ঘোষণা করা হলো ৩০ টাকার পণ্য রফতানি করা হয়েছে এবং ৩০ টাকাই দেশে আনা হলো। কিন্তু কম মূল্য দেখিয়ে পাচার করা হলো ১৭০ টাকা। এমন অভিযোগের ভিত্তিতেই বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি যারা ইতোমধ্যে ৫০ হাজারের বেশি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে তাদের অর্থও ঠিকমতো দেশে এসেছে কি না, আর না এসে থাকলে কত দিন আটকা আছে এসব তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে রফতানি আয় ব্যাপকভিত্তিতে কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, অক্টোবরে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ১৩.৬৪ শতাংশ। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, যে পরিমাণে পণ্য রফতানি হচ্ছে ওই পরিমাণে আয় দেশে আসছে না। ডলার বাজার অস্থির হওয়ায় বেশি দাম পাওয়ার আশায় কিছু রফতানিকারক ডলার বিদেশে রেখে দিচ্ছেন। নানা অজুহাতে সেগুলো দেশে আনা থেকে বিরত থাকছেন। যে কারণে বাজারে ডলারের প্রবাহ কমেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে সব আয় দেশে আসেনি। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইপিবির রফতানি আয়ের হিসাবের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে। ইপিবি হিসাব করে পণ্য জাহাজীকরণের ভিত্তিতে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাব করে ডলার দেশের আসার ভিত্তিতে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবটিই প্রকৃত রফতানি আয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে প্রায় ১৫০ কোটি ডলারের রফতানি আয় যথা সময়ে দেশে আসেনি। এগুলো দেশে আনার জন্য ব্যাংকগুলোকে তাগাদা দেয়া হচ্ছে। ব্যাংক সংশ্লিষ্ট রফতানিকারকের সাথে যোগাযোগ করছে।


অনুরূপভাবে আমদানির আড়ালেও কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। যেমন- কম দামের পণ্য বেশি মূল্য দেখানো হচ্ছে। পাশাপাশি তিন লাখ ডলার সমপরিমাণ পণ্য আমদানির জন্য আমদানি ঋণপত্র স্থাপন করা হলেই ওইসব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠাতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি জোরদারের কারণে ইতোমধ্যে ভুয়া আমদানি কমে এসেছে। এতে সামগ্রিক আমদানি ব্যয় কমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মত প্রায় ২৪ শতাংশ, যেখানে আগের বছরে বেড়েছিল প্রায় ১২ শতাংশ।


এ দিকে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমদানির আড়ালে দেশ থেকে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচার করা অর্থে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা কোম্পানি বানিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ওইসব ব্যবসার কোনো মুনাফা দেশে আসছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের মার্চে সর্বোচ্চ ৯৫১ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এসব আমদানির একটি অংশ পাচার হচ্ছিল। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ৪৭৬ কোটি ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। এলসি খোলার হার প্রায় অর্ধেক কমেছে। ফলে এক দিকে ডলারের খরচ কমেছে, অন্য দিকে রিজার্ভ সাশ্রয় হচ্ছে।


এ দিকে ডলারের সরবরাহ কমে যাওয়ায় স্থানীয় টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েই যাচ্ছে। নানা উদ্যোগের পরেও কোনোভাবেই তা ঠেকানো যাচ্ছে না। আমদানি পর্যায়ে প্রতি ডলার ১১১ টাকায় লেনদেনের কথা বলা হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে তার চেয়ে বেশি দামে লেনদেন হচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংক প্রতি ডলার রেমিট্যান্স আহরণ করতে ১২৬ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করছে। বিক্রি করছে ১২৭ টাকা দরে। যদিও তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রতিবেদন দিচ্ছে ১১১ টাকা। বাকি অর্থ আগাম ডলার বিক্রির নামে প্রিমিয়াম হিসেবে বাড়তি অর্থ নিচ্ছে আমদানিকারকদের কাছ থেকে। এভাবে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে ইতোমধ্যে ব্যাংকারদের একাংশ এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেয়া হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে যেসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করেছে। তারা বলেছে, বিদেশে অবস্থিত এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোতে ডলারের আগাম বুকিং দেয়া হয়েছে। সুতরাং রাতারাতি তা বন্ধ করা যাবে না। এটা করা হলে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ কারণে তারা কয়েক দিন সময় চেয়েছে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।


এ দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ প্রতি মাসেই গড়ে এক বিলিয়ন ডলার কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ইতোমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের ঘরে নেমে এসেছে। তবে আইএমএফের হিসাবে তা আরো কম। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে আর আগের মতো সহযোগিতা করা হচ্ছে না। সরকারের নির্দেশে ইতোমধ্যে যেসব সরকারি ব্যাংক পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছিল তারা বেকায়দায় পড়ে গেছে। প্রতিনিয়তই যথাসময়ে আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে না পারায় জরিমানা বা বাড়তি সার্ভিস চার্জ গুনতে হচ্ছে। এতে ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হচ্ছে ব্যাংকগুলোর।


শেয়ার করুন