উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারি বৃষ্টিপাতে সিলেট-সুনামগঞ্জের পর নেত্রকোনা-শেরপুরেও বন্যা দেখা দিয়েছে। এসব জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জনজীবনে নেমে এসেছে চরম ভোগান্তি। গৃহপালিত পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে তারা। প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
শেরপুর: ভারিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে নয় দিনের মাথায় ফের আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে শেরপুরের সীমান্তবর্তী উপজেলার নিম্নাঞ্চলে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে ভারিবর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলের পানিতে দ্বিতীয় দফায় শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশী ও সোমেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এ প্লাবন দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার মহারশী এবং সোমেশ্বরী নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সদর, ধানশাইল, গৌরীপুর, হাতিবান্দা ও মালিঝিকান্দাসহ ৫ ইউনিয়নের ২০ গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার রামেরকুড়া, দিঘীরপাড়, চতলের বেড়িবাঁধ ভেঙে উপজেলা সদর এবং আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ওইসব গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
পানির চাপে শুক্রবার (১৭ জুন) সকালে রামেরকূড়া গ্রামের বাঁধের কাছে থাকা একটি বাড়ি ও পোলট্রি খামার ভেসে গেছে। সেই সঙ্গে ওই গ্রামের বেশ কয়েকটি বাড়ির মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ায় স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাত থেকে ঝড়োহাওয়া ও ভারি বর্ষণের কারণে উপজেলার সর্বত্র বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে মোবাইল নেটওয়ার্কও সমস্যা হচ্ছে। যাদের মোবাইল চার্জ দেওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা নেই তারা সব প্রকার যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন।
এদিকে উজানের ভারতের মেঘালয়ের বিভিন্ন পাহাড়ি নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রাম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারুক আল মাসুদ জানিয়েছেন, দ্বিতীয় দফায় আজ শুক্রবার সকাল থেকে উপজেলা সদরে ও বিভিন্ন গ্রামে পানি আসতে শুরু করেছে। বৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হলে বন্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। প্রথম দফায় বন্যার্তদের মাঝে জেলা প্রশাসনের বরাদ্দের ১৫ মেট্রিক টন চালের মধ্যে ইতোমধ্যে ১০ মেট্রিক টন বিতরণ করা হয়েছে; বাকি চাল বিতরণ করা হবে। এছাড়া বর্তমানে যারা পানিবন্দি হয়ে রয়েছেন তাদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
গত ৯ জুন সকালে ঝিনাইগাতী উপজেলার সোমেশ্বরী ও মহারশী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২০ গ্রাম আকস্মিক বন্যাকবলিত হয়। গত ৯ দিনে ওই সব এলাকার পানি নেমে গেলেও শুক্রবার সকাল থেকে আবারো ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন করে ২০ গ্রাম প্লাবিত হলো।
শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী মো. শাহজাহান জানান, বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত নালিতাবাড়ী উপজেলায় ১১৫ মিলিমিটার এবং শেরপুর সদর উপজেলায় ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া সীমান্তের পাহাড়ি নদীর সবটিতেই বিপৎসীমানার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলেও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি জামালপুর-শেরপুর পয়েন্টে এখনো বিপৎসীমার প্রায় ৫ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নেত্রকোনা: উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারি বৃষ্টিপাতে নেত্রকোনার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও বারহাট্টা উপজেলায় বন্যা হচ্ছে। বিশেষ করে কলমাকান্দার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উপজেলার আটটি ইউনিয়নের ৩৪৩ গ্রামের মধ্যে বেশিরভাগ গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এতে প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ শুক্রবার সকালে বলেন, ‘কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও বারহাট্টা উপজেলার মধ্যে কলমাকান্দায় বেশি বন্যা হচ্ছে। ক্রমশ পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। তিনটি উপজেলায় প্রচুর মানুষ পানিবন্দি। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢুবে যাচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বন্যাকবলিত প্রতিটি উপজেলায় ২০ টন করে চাল ও দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে শুকনো খাবারসহ ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে।’
সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি চরম অবনতি হয়েছে। এতে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জেলার সদরসহ ছাতক, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর ও শান্তিগঞ্জ এই ছয়টি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। পানিবন্দি লোকজন চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। সুনামগঞ্জ জেলা সদরে বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জ শহরেরর ৬০ ভাগ বাসাবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন শহরবাসী।
সুনামগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহেদ হাসান বলেন, ‘সুনামগঞ্জ শহরের ৮০ ভাগ দোকানপাট পাহাড়ি ঢলের পানিতে নিমজ্জিত। দোকান ঘরে পানি ঢুকায় ব্যবসায়ীরা চরম বিপাকে পড়েছেন। এমন অবস্থায় অনেকে দোকানপাট বন্ধ করে রেখেছেন। এতে ক্রেতা সাধারণ পড়েছেন দুর্ভোগে।’
সিলেট: টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সিলেট নগরীসহ বেশ কয়েকটি উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বন্যাকবলিতদের। বন্যার কারণে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। বাড়িঘরেও ঢুকে পড়েছে পানি। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছে বন্যার পানি চলে আসায় বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুতের গ্রিড উপকেন্দ্র রক্ষা করতে কাজ শুরু করেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। দুপুর ১২টার দিকে গ্রিড উপকেন্দ্রে পানি প্রবেশ বন্ধ করতে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সিলেট বিক্রয় ও বিতরণ অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দুপুর ১২টা থেকে জিও ব্যাগ ফেলে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে পানি প্রবেশ ঠেকাতে কাজ করছেন। তাদের সঙ্গে সিলেট সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মীরা কাজ করছেন।