টানা ১৫ বছর ধরে রাজশাহী সদর-২ আসনে সংসদ সদস্য (এমপি) হয়ে আছেন বাংলাদেশের ওয়াকার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসন বাদশা। তিন বারই তিনি তাঁর দলের হাতুড়ি প্রতীক ফেলে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। তবে এই ১৫ বছরে রাজশাহীর উন্নয়নে তেমন ভূমিকা রাখতে না পারা এবং জোটের প্রধান শরিক দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করা নিয়ে এবার শুরু থেকেই ছিলেন চরম চাপের মুখে। এই অবস্থায় এবার নৌকা পাওয়া নিয়ে চরম অনিশ্চিয়তাও তৈরী হয়েছিল।
জোটের নেতাকর্মীরা বলছেন, রাজশাহী মহানগরীতে বাদশার নিজস্ব কোনো ভোট ব্যাংক না থাকলেও মজাজোটের চাপে শেষ পর্যন্ত তাঁর হাতেই টানা চতুর্থ বারের মতো নৌকা তুলে দেওয়া হয়েছে। নৌকা পেয়ে গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনী প্রচারণাতেও নেমেছেন বর্তমান এ এমপি। কিন্তু এখন পর্যন্ত মহাজোটের অন্য কোনো দলের নেতাকর্মীকে তাঁর পক্ষে মাঠে নামাতে পারেননি তিনি। বরং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ আলী কামালকে সঙ্গে নিয়ে।
এমরকি জাসদের মহানগর সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ শিবলিও আলাদা ভোট করছেন। এমপি বাদশার পাশে নাই ন্যাপসহ অন্য দলের নেতারাও।
এ অবস্থায় বাদশা হয়ে পড়েছেন কোণঠাসা। সাধারণ ভোটারদেরও পাশে না পাওয়ায় তার গণসংযোগেও তেমন লোকজন হচ্ছে না। ফলে ১০-১২ জনকে সঙ্গে নিয়ে এমপি ফজলে হোসেন বাদশা দায়সারা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশার পক্ষে মাঠে নেমেছেন মহানগর আওয়ামী লীগসহ তৃণমূলের শত শত নেতাকর্মীরা। তারা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে শফিকুর রহমানের পক্ষে ভোট চাইছেন। এই অবস্থায় সাধারণ ভোটাররাও মনে করছে ফজলে হোসেন বাদশা নৌকা পেলেও এবার তার ভরাডুবি কেউ থামাতে পারবে না।
রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, এমপি ফজলে হোসেন বাদশা গত ১৫ বছরে মহানগর আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে বৈরীতা সৃষ্টি করে চলেছেন, এবার তার প্রতিফলন দেখাবে মহানগর আওয়ামী লীগ। এবার কোনোভাবেই বাদশাকে ছাড় দিতে রাজি নন তাঁরা। যে কারণে প্রচারণা শুরু হওয়ার পরে নৌকার প্রার্থী বাদশা হলেও তাঁর পক্ষে মহানগর আওয়ামী লীগের কেউ মাঠে নামেননি। এরই মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুর রহমান বাদশার হয়ে মাঠে নেমেছেন সভাপতি মোহাম্মদ আলী কামলাসহ মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ-ছাত্রলীগের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
দলীয় সূত্র মতে, মহাজোটের প্রার্থী হয়ে ফজলে হোসেন বাদশা গত তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়ে প্রতিবারই রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে পড়েছিলেন। এমনকি মানববন্ধন থেকে প্রকাশ্যে লিটন এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়েও বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। এসব কারণে চরম ক্ষুব্ধ মেয়র লিটন। এর বাইরে জেলার একাধিক এমপি এবং মহানগর আওয়ামী লীগের অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও বিভিন্ন সময়ে দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে পড়েন এমপি বাদশা। এটিই তাঁর জন্য এবার চরম সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, এমপি বাদশা তিন বার এমপি হয়ে তিনি রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের কোনো উপকারে আসেননি। উল্টো তাঁর প্রাপ্ত সরকারি বরাদ্দগুলো তিনি নিজ সংগঠনসহ বিভিন্ন ভূঁইফোড় সংগঠনের নামে বরাদ্দ দিয়ে কোটি কোটি টাকা তোছরুপ করেছেন। এসব বরাদ্দগুলোর তালিকা সম্প্রতি গণমাধ্যকর্মীদেরও হাতে এসে পৌঁছে। তাতে দেখা যায় গত ৫ বছরেই এমপি ফজলে হোসেন বাদশা টিআর-কাবিখা প্রকল্প থেকে যেসব বরাদ্দ দিয়েছেন, তার অধিকাংশরই কোনো হদিশ নাই। আর নিয়ে চরম বিরক্ত মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও।
রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী কামাল বলেন, ‘রাজশাহী সদর আসনে দলের নেতাকর্মীরা আর অন্য কাউকে চাই না। গত ১৫ বছরে রাজশাহী সদর আসনে নৌকা প্রতীক অন্য দলের হাতে তুলে দেওয়ায় এখানে আওয়ামী লীগের অনেক ক্ষতি হয়েছে। যিনি নৌকা নিয়ে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিলেন, তিনি পরবর্তিতে ভুলে গিয়েছিলেন যে তিনি আওয়ামী লীগের শরিক দলের এমপি। সে কারণে এখানে আওয়ামী লীগের ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়নি। কাজেই এবার মহানগর আওয়ামী লীগ তাঁকে আর কোনো ধরনের ছাড় দিতে চাই না। আমরা কাজ করছি মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুর রহমান বাদশার হয়ে। তাকেই নির্বাচিত করতে চাই।’
রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক আহসানুল হক পিন্টু বলেন, ‘এমপি বাদশাকে গত তিন বার মনোনয়ন দেওয়ায় রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের বড় ক্ষতি হয়েছে। এবার আমরা আশা করেছিলাম দলের নেতাদের মধ্যেই নৌকা থাকবে। দলের মহানগর সভাপতি মোহাম্মদ আলী কামালকে প্রথমে নৌকা প্রতীক দেওয়া হলে পরবর্তিতে সেটি বাতিল করে আবারও বাদশার হাতে নৌকা তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে আমাদের যেহেতু তিনি কখনো মূল্যায়ন করেননি, সেহেতু তাঁর হয়ে কাজ করার প্রশ্নই আসে না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনকি সম্পাদক পদের আরেক নেতা বলেন, ‘হাতুড়ি প্রতীক ফেলে ফজলে হোসেন বাদশা এবারও নৌকা নিয়ে নির্বাচন করছেন। তিনি তার মতো নির্বাচন করুক আমরা আমাদের মতো নির্বাচন করবো। আমরা তাকে বাধা দিতে চাই না। কিন্তু তার হয়ে মাঠে নামতে পারব না। আমরা আমাদের দলের প্রার্থীর হয়ে কাজ করবো।’