রাজধানীসহ দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই ঘটছে অগ্নিদুর্ঘটনা। প্রতিনিয়ত মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি একের পর এসব ভয়াবহ আগুন লাগার পেছনে কারণ হিসেবে উঠে আসছে নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার। আর এসব নকল বৈদ্যুতিক তারে বাড়ছে অগ্নিদুর্ঘটনার শঙ্কা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তারের কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে।
দৈনিক ইত্তেফাকের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) প্রদত্ত তথ্যে জানা যায়, দেশে বর্তমানে ১৮টি প্রতিষ্ঠানের ক্যাবল, আটটি প্রতিষ্ঠানের সুইচ-সকেট ও ৩৮টি প্রতিষ্ঠানের ফ্যান তৈরির লাইসেন্স আছে। এছাড়া, অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির লাইসেন্স আছে মাত্র ২২টি প্রতিষ্ঠানের। লাইসেন্স ছাড়া প্রায় শতাধিক কারখানায় তৈরি নকল পণ্য দিয়ে বাজার সয়লাব। এরসঙ্গে কিছু ব্যবসায়ী যারা, বৈধ-অবৈধ্ভাবে বিদেশ থেকে অতি নিম্নমানের পণ্য আমদানি করে দেশে বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের নামে বিক্রি করছে।
জানা যায়, অনেকে প্রতিষ্ঠিত বৈদ্যুতিক পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তৈরি করছেন নকল কারখানা।
নতুন মোড়কে দামি ব্র্যান্ডের লোগো হুবহু ব্যবহার করে বাজারজাত হচ্ছে এসব নকল পণ্য। দেশের বাইরে থেকেও আসছে নিম্নমানের পণ্যের একটা বড় অংশ। দেশি-বিদেশি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বৈদ্যুতিক পণ্য নকল করা হচ্ছে। খোদ রাজধানীতেই রয়েছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর বংশাল, নবাবপুর, সিদ্দিকবাজার, জিনজিড়া, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসহ সারাদেশেই নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি তৈরির কারখানার সন্ধান মিলেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নকল বৈদ্যুতিক তার কিনে গ্রাহক শুধু আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছেন না, এটার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে মৃত্যুর ফাঁদ। ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে সাম্প্রতিক আগুনের ঘটনাগুলোর ৭৫ থেকে ৮০ ভাগের পেছনে দায়ী মানহীন বৈদ্যুতিক তার ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি।
নকল ও মানহীন পণ্য বাজারে বিক্রি করে সেগুলো মানহীন উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, ‘বাজারের অধিকাংশ পণ্য অত্যন্ত নিম্নমানের এবং এতে প্রথমত ভোক্তা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। কারণ, সেটা যদি ইলেকট্রিক তার বা অন্যকিছু হয় তবে বেশি বিদ্যুৎ খরচ করে। আবার, কিছুদিন ব্যবহারে কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে গিয়ে নানা দুর্ঘটনা ঘটার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, নবাবপুরের কাপ্তান বাজার দেশের সবচেয়ে বড় বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বিকিকিনির এই এলাকার প্রতিটি দোকানেই পাওয়া যায় স্বনামধন্য কেবল কোম্পানির নকল বৈদ্যুতিক তার। এমনকী কোনো কোনো দোকানে কোম্পানির স্টিকার দেওয়া থাকলেও সে স্টিকারও নকল করে সাঁটানো হয় তারের কয়েলে।
এসব নকল তারের ভোক্তা কারা এমন প্রশ্নে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিক্রেতারা জানান, ‘যেসব কোম্পানি ভবন নির্মাণের দায়িত্বে থাকেন, তারাই অতি লাভের আশায় মানের সঙ্গে সমঝোতা করেন। অন্যদিকে নিখুঁতভাবে নকল হওয়ায় মূল ভোক্তাও বুঝতে পারেন না আসল নকলের পার্থক্য। বেশিরভাগ ক্রেতাই কমদামি তার খোঁজেন। তাদের যা প্রয়োজন আমরা তা সরবরাহ করি, তবে এটা ঠিক-এসব নকল তারে শর্ট সার্কিটের ঝুঁকি বেশি।’
প্রায়সময়ই দেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী ভেজাল বিরোধী অভিযান করে থাকে। গত ১১ জানুয়ারি র্যাব-১০ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। এ সময় অনুমোদনহীন ও নকল বৈদ্যুতিক তার উৎপাদন, মজুদ ও বিক্রি করার তথ্যপ্রমাণ পেয়ে পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে মোট ২৬ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
র্যাব-১০ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) এনায়েত কবির সোয়েব জানান, ‘রাজধানীর পুরাতন ঢাকার এলাকায় বেশ কিছুদিন ধরে অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধ ও গোপন কারখানায় বিআরবি, বিজলী ক্যাবলস, প্যারাডাইস ক্যাবলস, ইস্টার্ন ক্যাবলস, পলি ক্যাবলস, বিবিএস ক্যাবলসের নামে নকল ও মানহীন বৈদ্যুতিক তার উৎপাদন হচ্ছিল। অনুমোদনহীন ও নকল বৈদ্যুতিক তার উৎপাদন, মজুদ ও বিক্রি করার অপরাধে ইভানা ক্যাবলস ইন্ডাস্ট্রিকে ২০ লাখ টাকা, এমআরবি ক্যাবলসকে দুই লাখ টাকা, জিহান ক্যাবলসকে এক লাখ টাকা, নাভা ক্যাবলসকে এক লাখ ও রহিম মেটালসকে দুই লাখ টাকা করে মোট ২৬ লাখ টাকা জরিমানা করেন।’
বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ধরন ও তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে ফায়ার সার্ভিস বলছে, বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের কারণই বৈদ্যুতিক গোলযোগ। অর্থাৎ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে সহজেই শর্টসার্কিট হয়ে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। আবাসিক ভবন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও এখন আগুন লাগার প্রধান কারণ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার। এছাড়া আগুন লাগার আরেকটি বড় কারণ বিড়ি-সিগারেট ও রান্নার চুলা।
দেশের সবচেয়ে আলোচিত আগুন লাগার একটি হলো রাজধানীর বনানীর বহুতল বাণিজ্যিক ভবন এফআর টাওয়ারের (ফারুক রূপায়ণ টাওয়ার) ঘটনা। ওই দুর্ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন অন্তত ৭০ জন। ওই ঘটনার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, অষ্টম তলার শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। পরবর্তীতে তা ওপরের নবম ও দশম তলায় ছড়িয়ে পড়ে। ধোঁয়ার কারণে হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০২২ সালের প্রথম চার মাসেই (জানুয়ারি-এপ্রিল) দেশে অগ্নিকাণ্ডে ৬৫৩ জনের মৃত্যু এবং আহত হন ৬ হাজার ২৭ জন, ২০২১ সালে মারা গেছেন ২১৯ জন এবং আহত হন ৫৭০ জন, ২০২০ সালে মৃত্যু ১৫৪ এবং আহত হন ৩৮৬ জন, ২০১৯ সালে মৃত্যু ১৮৫ এবং আহত হন ৫৮৬ জন, ২০১৮ সালে মৃত্যু ১৩০, আহত ৬৭৭ জন এবং ২০১৭ সালে ৪৫ জনের মৃত্যু ও আহত হন ২৮৪ জন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া সেলের সিনিয়র স্টাফ অফিসার মো. শাহজাহান শিকদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দেশে এক নম্বর জিনিস পাওয়াই কঠিন। শর্ট সার্কিট থেকে ৭০-৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। বাজারে ভেজাল বৈদ্যুতিক ক্যাবল সহজলভ্য। নকল ও মানহীন সার্কিট ব্রেকারও পাওয়া যায়।’