সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ নানা দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করছে বিএনপি। একদফা দাবিতে ছয় মাসের বেশি সময় রাজপথে আছে দলটি। বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে শরিক হয়েছে সমমনা দলগুলো। হরতাল, অবরোধসহ অসহযোগ আন্দোলনের মতো কর্মসূচি পালন করলেও চূড়ান্ত সাফল্য পায়নি এখনো। উলটো নানা সংকটে দলটি। শীর্ষ নেতাদের অনেকেই কারাবন্দি। ২৮ অক্টোবরের পর সারা দেশের হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলে। মামলায় জর্জরিত কয়েক লাখ নেতাকর্মী ঘরছাড়া। সাজাও হয়েছে অসংখ্য কেন্দ্রীয় নেতার। এরই মধ্যে বিরোধীদের দাবি উপেক্ষা করে নির্বাচন এবং নতুন সরকার গঠন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর সরকারবিরোধী দলগুলো একরকম ‘ধীরে চলো নীতি’ অনুসরণ করছে। তবুও আত্মবিশ্বাসী দলটির নেতাকর্মীরা। তারা বাস্তবসম্মত ও কার্যকরী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণ চান। এজন্য নেতাকর্মীদের কারামুক্তিতে জোর দেওয়ার পাশাপাশি কর্মসূচি বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় নেতাদের মাঠে চায় বিএনপির তৃণমূল। ৯টি জেলার অন্তত ১৩ জন শীর্ষ নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, দীর্ঘদিন আন্দোলন করে এলেও নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি বিএনপি। শাস্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচি সফল হয়েছে। ৭ জানুয়ারি এর প্রমাণ মিলেছে। জনগণ বিএনপির ডাকা কর্মসূচিতে সাড়া দিয়ে ভোট বর্জন করেছে। আগামী দিনেও গণতান্ত্রিক কর্মসূচি আসবে। সেখানে জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সরকারের পতন ঘটানো হবে। নেতাকর্মীরাও সক্রিয়ভাবে মাঠে আছেন। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো শিগগিরই নতুন কর্মসূচিতে যাবে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকার্মীরা সংগঠিত হয়ে সেই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন। গত বছরের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনের মহাসমাবেশ পণ্ডের পর বিএনপির প্রায় ২৫ হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ ৩ জন স্থায়ী কমিটির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই কারাবন্দি। তাদেরকে মুক্তকরণের পাশাপাশি গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন অব্যাহত রাখা হবে। একই সঙ্গে বহির্বিশ্বের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রয়েছে। পরিবেশ ও পরিস্থিতির আলোকে যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের কর্মসূচি আসবে।
জেলার নেতারা বলেন, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ পণ্ডের পর বিএনপি লাগাতার কর্মসূচি দিলেও কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে নামেননি। শীর্ষ কয়েকজন গ্রেফতার হলে কেন্দ্রীয় নেতারা আত্মগোপনে যান। এই সময়ে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী ছাড়া কেন্দ্রীয় নেতাদের দেখা যায়নি। ফলে মামলা-হামলায় জর্জরিত এবং নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা গ্রেফতার আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়ে বনজঙ্গল, ফসলি জমি, খোলা মাঠে রাত্রিযাপন করেছেন। হরতাল-অবরোধে দিনে বিভিন্ন স্থানে মিছিলসহ পিকেটিং করেছেন। অনেকেই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আতঙ্কে এখনো তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বাড়ি যেতে সাহস পাচ্ছেন না। এজন্য গণতন্ত্রের মুক্তি ও সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত বিএনপিকে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতি বাড়াতে জোর দেওয়া জরুরি।
ওইসব নেতা আরও বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ভোট বর্জনের পক্ষে গণসংযোগ ও অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা দিলেও কেন্দ্রীয় নেতারা আত্মগোপন থেকে বের হননি। এতে সরকারবিরোধী আন্দোলন কাক্সিক্ষত মাত্রায় পৌঁছেনি। সেই সুযোগে সরকার একরকম নির্বিঘ্নে নির্বাচন করার সুযোগ পেয়েছে। যদিও ভোটকেন্দ্রে ভোটার যায়নি। বিএনপি প্রাথমিকভাবে একদিকে সফল। দেশবিদেশে একতরফার নির্বাচন ‘ডামি নির্বাচন’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এর মধ্যে তারা সরকারবিরোধী আন্দোলন নানাভাবে চালিয়ে নিয়েছেন। বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সামনে থেকে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। সামনের দিনেও নতুন কর্মসূচি আসবে। কেন্দ্র থেকে যেভাবে নির্দেশনা দেবে, আমরা সেটাই বাস্তবায়ন করব।
দিনাজপুর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ কচি বলেন, একদফা দাবিতে আমরা যে আন্দোলনে ছিলাম, সেটায় আমরা সফল। মানুষ যেভাবে ভোট বর্জন করেছে, সেদিক দিয়ে তাকালে বিএনপির আন্দোলন সফল হয়েছে। সরকারের পতন না ঘটলেও যেনতেনভাবে টিকে আছে। ৭ জানুয়ারি যেটা হয়েছে, এটাকে কেউ নির্বাচন বলে না। সরকার জোর করে আছে। এখন সামনের দিনে সমমনা দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যেভাবে কর্মসূচি ঘোষণা দেবে, আমার সেভাবেই আন্দোলন করে যাব।
দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতারা প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে বলছেন, দেশের অধিকাংশ মানুষ বিএনপির আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি আরও কঠোর হতে পারত। তবে নির্বাহী কমিটি ও অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ নেতারা আত্মাগোপনে থাকায় নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। রাজধানীতে যেভাবে আন্দোলন হওয়ার কথা ছিল, এর কিছুই হয়নি। বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি অঙ্গ সংগঠনের নেতারা ফাঁকা রাস্তায় কিংবা অলিগলিতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে শীর্ষ নেতাদের কাছে পাঠিয়ে দায় এড়িয়েছেন। সামনের দিনে যেসব কর্মসূচি আসবে, সেখানে কেন্দ্রীয় নেতাদের মাঠে চান নেতারা।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সিনিয়র নেতারা নিজ নিজ জায়গা থেকে সর্বোচ্চ কাজ করেছেন। তারা আন্দোলনকে নানাভাবে গতি দিয়েছেন। এত মামলা, হামলা ও গণগ্রেফতারের মধ্যেও তারা কর্মসূচি পালন করেছেন। স্থায়ী কমিটির নেতারাও রাস্তায় রাস্তায় মিছিল, লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ করেছেন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও জনগণ বিএনপির পক্ষে ছিল। আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মী কারাবন্দি। এর মধ্যেও কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সর্বোচ্চ দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে গত বছরের ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ পণ্ডের পর লাগাতর আন্দোলনে যায় বিএনপি। সমমনা দলগুলো নিয়ে ১২ ধাপে ২৪ দিনের অবরোধ এবং পাঁচ ধাপে ছয়দিনের হরতাল পালন করে দলটি। এতে রাজধানীসহ সারা দেশে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতি তেমন একটা দেখা যায়নি। তৃণমূলে নেতাকর্মীদের উপস্থিতিও ছিল নগণ্য। পরবর্তী সময়ে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ভোট বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় বিএনপিসহ মিত্ররা। লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ করেন দলগুলোর নেতাকর্মীরা। আন্দোলনে থাকা নেতাদের দাবি, জনগণ এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে ভোটদানে বিরত ছিল। ফলে নির্বাচনের পরে সাধারণ জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লিফলেট বিতরণ করেছে সরকার বিরোধী দলগুলো। এরই মধ্যে নতুন কর্মসূচি নির্ধারণে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি হাইকমান্ড। ৯ জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে এই বৈঠক শুরু হয়। দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নতুন কর্মসূচি নির্ধারণ হওয়ার কথা রয়েছে।