দেশের সব খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। বর্তমানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে বিপুল পরিমাণ কয়লার প্রয়োজন। চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানীকৃত কয়লার মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে। আগামী দিনে কয়লার চাহিদা আরো বাড়বে।
বৃহৎ এই চাহিদা পূরণ এবং আমদানি ব্যয় সাশ্রয়ের পথ খুঁজতেই এখন খনিগুলো থেকে কয়লা উত্তোলন শুরুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
দেশে বর্তমানে পাঁচটি কয়লাখনি রয়েছে। এর মধ্যে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া খনিটিতে ২০০৫ সাল থেকে উত্তোলন কার্যক্রম চলছে। আবিষ্কৃত বাকি চারটি খনি থেকে এত দিন কয়লা উত্তোলন নিয়ে জোরালো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও জ্বালানি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, কৃষিজমি সংরক্ষণ করে কয়লা উত্তোলন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে উচ্চ পর্যায় থেকে। কৃষিজমি নষ্ট হবে—এই বিবেচনায় এত দিন সরকার উত্তরবঙ্গের কয়লাখনি উন্নয়ন করা থেকে বিরত রয়েছে। এখন যেহেতু কয়লার চাহিদা বেড়েছে, এই চাহিদা পূরণে কৃষিজমির ক্ষতি না করে কয়লা উত্তোলনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
দেশের খনিগুলো থেকে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি সচিবালয়ে বলেন, ‘আমরা কয়লা উত্তোলনের কয়েকটি অপশন তৈরি করেছি।
কৃষিজমি ও পরিবেশের ক্ষতি না করে যতটুকু পারা যায় কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে এসেছি। বিষয়টি নিয়ে শিগগির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমরা বসব। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেলে অতি দ্রুত আমরা কয়লা উত্তোলনে যাব।’
কয়লা উত্তোলন কার্যক্রমের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন যেভাবে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে, এতে পাশের জমিগুলোর মাটি দেবে গিয়ে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কয়লা উত্তোলন করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।
এতে খনির পাশের এলাকাগুলোর আবাদি জমি নষ্ট হবে না। এরই মধ্যে ভারতের কয়লার খনিগুলো আমাদের একটি টিম পরিদর্শন করে এসেছে।’
কবে নাগাদ খনিগুলো থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হতে পারে, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্য জানাতে পারেননি তিনি।
বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ কোল মাইনিং কম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) হিসাব মতে, দেশের পাঁচটি খনিতে সাত হাজার ৯৬২ মিলিয়ন টন মজুদ কয়লা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কয়লা মজুদ রয়েছে জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে। এই খনিতে কয়লার মজুদ রয়েছে পাঁচ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন টন। ফুলবাড়ীতে মজুদ আছে ৫৭২ মিলিয়ন টন। বড়পুকুরিয়ায় মজুদ রয়েছে ৩৯০ মিলিয়ন টন ও দীঘিপাড়ায় মজুদকৃত কয়লা ৮৬৫ মিলিয়ন টন এবং খালাশপীরে কয়লা মজুদ আছে ৬৮৫ মিলিয়ন টন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এমনিতেই আবাদি জমির পরিমাণ কম। তাই কৃষিজমি নষ্ট করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সুযোগ নেই। বড়পুকুরিয়ার মতো ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতেই কয়লা উত্তোলনে যেতে হবে। তবে নতুন খনিতে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে আরো আধুনিক প্রক্রিয়ায় কয়লা উত্তোলনের কার্যক্রম নিতে হবে।
জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে জ্বালানির অবস্থা ঘাটতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কারণ চাহিদার তুলনায় গ্যাস ও কয়লার উৎপাদন যথেষ্ট নয়। ডলার সংকটে আমদানিতেও অসুবিধা হচ্ছে। তাই কয়লা খনিগুলো থেকে পর্যায়ক্রমে খনন করে উত্তোলন করা গেলে কয়লার চাহিদার বড় একটি অংশই পূরণ করা সম্ভব হবে। স্থানীয় উৎসর ওপর নির্ভরতা বাড়বে। সাশ্রয় হবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।
বদরূল ইমাম বলেন, খনিগুলো থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা যাবে না। যদিও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা বেশি উত্তোলন করা যায়। এর পরও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা উচিত হবে না। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষিজমি। তাই আধুনিক উপায়ে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে হবে।
দেশে বর্তমানে সাত হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন। এ ক্ষেত্রে মূলত আমদানীকৃত কয়লার ওপর নির্ভর করা হচ্ছে। যদিও বিভিন্ন সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, দেশি কয়লা মানের দিক থেকে বেশ ভালো বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও নরওয়ের বহুজাতিক তেল-গ্যাস কম্পানি স্টেট অয়েলের (বর্তমানে ইকুইনর) গবেষক মুহাম্মদ আমিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের জ্বালানি কয়লা খুবই উন্নতমানের এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। আমাদের কয়লাখনিগুলোর উন্নয়ন করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার চাহিদা পূরণ করতে পারবে। এতে দেশের অর্থনীতি গতিশীল হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কম পড়বে।’