২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০২:৫৫:৫৫ অপরাহ্ন
উচ্চ শুল্ক ও ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ পাঁচ কারণ
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-০১-২০২৪
উচ্চ শুল্ক ও ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ পাঁচ কারণ

উচ্চ শুল্ক ও ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ পাঁচ কারণে রমজানের তিন পণ্য-চিনি, ভোজ্যতেল ও খেজুরের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা যাচ্ছে না। অন্য কারণগুলো হচ্ছে-বিশ্ববাজারে পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি, আমদানি মূল্যকে ভিত্তি না ধরে শুল্কায়ন পদ্ধতি এবং পরিশোধন ব্যয় বৃদ্ধি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্থানীয় বাজারে মূল্য সমন্বয়ও সম্ভব হচ্ছে না। এ তিন পণ্যের মূল্য পরিস্থিতির ওপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। তবে এসব কারণে পণ্যের দাম যতটুকু বাড়ার কথা, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এরচেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এর নেপথ্যে রয়েছে সিন্ডিকেটের কারসাজি।


শুল্কের বিষয়ে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এক কেজি চিনি আমদানিতে শুল্ক আদায় করা হচ্ছে সর্বোচ্চ ৪৬ টাকা ও খেজুরে ১৬০- ২০০ টাকা এবং ভোজ্যতেল টনপ্রতি ১৫ শতাংশ।


এদিকে রমজানকে সামনে রেখে ভোজ্যতেল, চিনি, খেজুর ও চালের ওপর উচ্চ শুল্ক হার কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ নির্দেশ দেন। তিনি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করতে বলেছেন।


রোজার এই তিন পণ্যে বেশি শুল্ক আরোপের কারণে বাজারে মূল্য বাড়ছে-এমন তথ্য প্রকাশ্যে নিয়ে আসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের ওপর শুল্ক কমানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেওয়া হয়। জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে জানান, ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের শুল্ক হার কমানো হলে এটি ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা হবে। এ উদ্যোগের ফলে ঘাটতি রাজস্ব পূরণের জন্য স্বাভাবিক ভ্যাট, আয়কর আদায়ে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধ করতে হবে। একই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে এ প্রস্তাব যদি কার্যকর হয় তাহলে এর সুফল যেন সাধারণ ভোক্তারা পান। সরকার দাম কমানোর জন্য শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করবেন, ব্যবসায়ীরা যদি আগের মূল্যেই বিক্রি করেন তাহলে এর সুফল ব্যবসায়ীদের পকেটে যাবে। এজন্য বাজার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং কঠোরভাবে পরিচালনা করতে হবে।


কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কম থাকায় চিনির ওপর শুল্ক বেশি মাত্রায় আরোপ করা হয়। এখন বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে এখন কমানো দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে শুল্ক হার একবার বৃদ্ধি পেলে সেটি আরও কমানো হয় না। এখন প্রধানমন্ত্রীর শুল্ক কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পরও আর আমাদের কেউ নেই। এখন আমরা আশা করব একটি যৌক্তিক পর্যায়ে শুল্ক আরোপ করা। তিনি আরও বলেন, রাজস্ব আহরণ ও দেশি শিল্প সুরক্ষার চেয়ে এখন বেশি গুরত্ব হবে ভোক্তার স্বার্থ। সেটি আমাদের দাবি।


চিনিতে উচ্চ শুল্ক : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, চটগ্রাম সিএন্ডএফ হিসাবে বর্তমান বিশ্ববাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনির মূল্য ৫৭০ থেকে ৫৮০ মার্কিন ডলার এবং পরিশোধিত চিনি ৬২০ থেকে ৬৪০ ডলার। এর ওপর প্রতি টনের ওপর আমদানি শুল্ক (সিডি) ১৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ এবং অগ্রিম কর ৫ শতাংশ এবং নিয়ন্ত্রণ শুল্ক ৩০ শতাংশ আরোপ করা হচ্ছে। প্রতি ডলার বিনিময় হার ১১০ টাকা ধরে হিসাব করলে এক কেজি পরিশোধিত চিনির ওপর ৪৩ থেকে ৪৬ টাকা এবং অপরিশোধিত চিনিতে ৩২ থেকে ৩৩ টাকা শুল্ক আদায় করা হচ্ছে।


পর্যালোচনায় দেখা গেছে, স্থানীয় আখ থেকে উৎপাদিত চিনির শিল্পকে সুরক্ষা দিতে আমদানিকৃত চিনির ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়। দেশের চাহিদা পূরণে বছরে ২২ লাখ টন চিনির প্রয়োজন। দেশি চিনি মোট চাহিদার মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ পূরণ করছে। বাকি ৯৮ দশমিক ৫ ভাগই আমদানি করতে হয়।


উচ্চ শুল্ক ছাড়াও টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণেও চিনির মূল্যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়। সেখানে আরও বলা হয়, গত এক মাসে বিশ্ববাজারে চিনির মূল্য বেড়েছে ১৮ শতাংশ এবং স্থানীয় বাজারে কেজিতে বেড়েছে ৩ থেকে ৫ টাকা। তৃতীয় কারণ হিসাবে বলা হয়, ভোক্তা পর্যায়ে সরাসরি চিনি ব্যবহারের পাশাপাশি ওষুধ ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পেও ব্যাপক চিনির ব্যবহার হচ্ছে। ফলে রোজায় বাড়তি চাহিদা পূরণসহ প্রতিযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্য স্থিতিশীল রাখতে অপরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্ক ১৫শ টাকা থেকে কমিয়ে ১ হাজার টাকা ও নিয়ন্ত্রণ শুল্ক ৩০ শতাংশ প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। পাশাপাশি পরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক তিন হাজার টাকা থেকে নামিয়ে ১৫শ টাকা এবং নিয়ন্ত্রণ শুল্ক ৩০ শতাংশ প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়।


সূত্র জানায়, গত বছর জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন লাখ ৩৮ হাজার ৮৭০ টন অপরিশোধিত চিনির এলসি খোলা হয়েছিল। এবার তিন লাখ ৮৭ হাজার ১৩৮ টন চিনি আমদানির এলসি খোলা হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি চিনির এলসি খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত আমদানির পরও প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায়।


খেজুর আমদানিতে শুল্ক আরোপ ১৬১ থেকে ২৫০ টাকা : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বর্তমান খেজুর আমদানি করা হলে শুল্কায়নের জন্য প্রতি টনের সর্বনিম্ন মূল্য ধরা হয় ২৫০০ মার্কিন ডলার বা ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এর ওপর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণ শুল্ক ৩ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম কর ৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ আরোপ করা হচ্ছে। ফলে সবমিলে সর্বনিম্ন আড়াই হাজার মার্কিন ডলারের উপর আরও ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে এক টন খেজুরের সর্বনিম্ন আমদানি মূল্য দাঁড়ায় ৩৯৬৫ মার্কিন ডলার বা ৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৫০ টাকা। টনপ্রতি শুল্ক আরোপ হচ্ছে ১ লাখ ৬১ হাজার ১৫০ টাকা। আর কেজিতে শুল্ক আদায় হচ্ছে সর্বনিম্ন ১৬১ টাকা। ব্যবসায়ীদের মতে, ভালো খেজুর সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা পর্যন্ত কেজিতে শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে।


বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রতি টনে ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপের কারণে স্থানীয় বাজারে খেজুরের মূল্য বৃদ্ধি এবং কাক্সিক্ষত সরবরাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে আরও বলা হয়, আসন্ন রমজানে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে খেজুর সরবরাহের লক্ষ্যে আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ এবং নিয়ন্ত্রণ শুল্ক ৩ শতাংশ তুলে নিতে হবে। পাশাপাশি শুধু ইনভয়েস মূল্যকে ভিত্তি ধরে শুল্কায়ন প্রয়োজন।


দেশে বছরে এক লাখ টন খেজুরের চাহিদা থাকলেও রোজায় ৫০ হাজার টনের দরকার হয়। জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৪ হাজার ৭৩৪ টন এলসি ওপেন করা আছে। আগের বছরে একই সময়ে আমদানির এলসি খোলা হয় ৩৭ হাজার ১০৭ টন।


জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমদানি করে খেজুর আনতে ২ মাস সময় লাগে। ডলার সংকটে পর্যাপ্ত এলসি খুলতে পারছি না। খেজুরের আমদানি শুল্ক কয়েক গুণ বাড়ানো হয়েছে।


এনবিআর ও কাস্টমসের সঙ্গে কথা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। তবে এখনো কোনো সমাধান হয়নি। তাই দাম বাড়ছে।


ভোজ্যতেলের ডলার মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে পড়েছে ভোজ্যতেলের বাজারে। একই সঙ্গে পরিশোধন ব্যয়ও বেড়েছে। উল্লিখিত দুই কারণে এই মুহূর্তে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্য কমানো যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পরিশোধিত/অপরিশোধিত পাম তেলের মূল্য হ্রাসে আরোপিত ভ্যাট হ্রাস কার্যকরী ভূমিকা রাখবে।


সেখানে আরও বলা হয়, ভোক্তা সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য আমদানি পর্যায়ে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পরিশোধিত/অপরিশোধিত পাম তেলের ওপর আরোপিত মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ৫ শতাংশ হারে নির্ধারণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আরোপিত সমুদয় ভ্যাট অব্যাহতি প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়।


গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি। দুই বছরে তা প্রায় ৩০ শতাংশ। এক বছর আগে ১ ডলার কিনতে খরচ হয়েছে ৯৫-১০০ টাকা, ২ বছর আগে ৮৪-৮৬ টাকা। আর এখন ১ ডলার কিনতে হচ্ছে ১১০-১১৬ টাকা দিয়ে।


সূত্র জানায়, ভ্যাট না কমিয়ে ভোজ্যতেলের মূল্য সমন্বয়ের চিন্তা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও এর প্রভাব কম পড়ছে দেশে। এর একটি কারণ হচ্ছে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যের পতন।


ইতঃপূর্বে ভোজ্যতেলের মূল্য হ্রাসে ২০২২ সালের ১৬ মার্চ অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ অপরিশোধিত সয়াবিন ও পরিশোধিত/অপরিশোধিত পাম তেলের ওপর আরোপিত মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ৫ শতাংশ হারে নির্ধারণ করেছিল।


শেয়ার করুন