দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও কাটেনি রাজনৈতিক সংকট। বিজয়ী হয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে ভোট বর্জনের পর আন্দোলনে থাকার সিদ্ধান্তে অনড় মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। নির্বাচন শেষ হলেও দুদলের সামনে এখনো রয়েছে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ। যার মধ্য সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে আন্দোলন ও কূটনীতি।
ক্ষমতাসীনরা মাঠ ছাড়তে নারাজ। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে আরও সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগ দলটির। এর সঙ্গে দ্রব্যমূল্য, সুশাসনসহ নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিচ্ছে। আর বিএনপি আগের দাবির সঙ্গে জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে সোচ্চার থাকবে। একই সঙ্গে পাশের দেশ ভারতসহ চীনের সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নয়নেও নজর তাদের। তবে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের নীতি পুনর্বিবেচনা চায়। এর বাইরে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখা, কারাবন্দিদের মুক্তির বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে দলটি।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী একাধিক অনুষ্ঠানে নতুন সরকারের সামনে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানান। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এমপি যুগান্তরকে বলেন, সরকারি দল হিসাবে সামনের দিনে আমরা আমাদের নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সচেষ্ট থাকব। পাশাপাশি আমাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডও এগিয়ে নেব। বিএনপির আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপির কর্মসূচি তো জনসম্পৃক্ততা হারিয়েছে। তাদের কর্মীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের আন্দোলনও ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যাবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ না খেতে পেরে হয়তো তা সহ্য করবে, কিন্তু ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে ছিন্ন করবে এটা মেনে নেবে না। ঠিক ৭ জানুয়ারি তাই হয়েছে। দেশের মানুষ উপলব্ধি করেছে নির্বাচন নামক প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। সে কারণে আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে তারা প্রহসনের ভোট বর্জন করেছে। সেখানেই আমাদের রাজনীতি সফল। সরকার দাবি মেনে নেয়নি কারণ তারা জনগণের সরকার নয়। আমরা যে দাবি জানিয়েছি, তা জনগণের দাবি। জনগণ গণতন্ত্র চায়। সরকার গায়ের জোরে বন্দুক বুলেট দিয়ে মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। মানুষ কিন্তু এটা অতীতেও মেনে নেয়নি, এখনো মেনে নেয়নি। জনগণের দাবি নিয়ে আমরা রাজপথে ছিলাম, আছি এবং থাকব।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ নিদর্লীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ নানা দাবিতে আন্দোলন করে আসছে বিএনপিসহ মিত্ররা। তাদের কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে পালটা কর্মসূচি দিয়েছে আওয়ামী লীগও। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে আন্দোলনের গতিপথ পালটে যায়। সারা দেশে চলে গ্রেফতার অভিযান। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ অন্তত ২৬ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দাবি দলটির। বিএনপি হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ আন্দোলন, গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ নিবন্ধিত আরও বেশ কয়েকটি দল। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
বিএনপি নেতারা জানান, আওয়ামী লীগ নিজেরা নিজেরা ‘ডামি’ নির্বাচন করেও ভোটে অনিয়ম করেছে। প্রকাশ্যে সিল মারতে দেখা গেছে কেন্দ্রে। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে জনগণ ভোট বর্জন করেছে এটা একটি সফলতা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব এ ভোট সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি বলে বিবৃতি দিয়েছে। দাবি আদায়ে তারা মাঠের আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন। ইতোমধ্যে ঢাকাসহ সব মহানগর, জেলা, উপজেলা ও পৌর অর্থাৎ সব ইউনিটে কালো পতাকা মিছিল কর্মসূচি পালন করেছে। শিগগিরই আবারও কর্মসূচি আসছে। আগের দাবির সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারাসহ নানা জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে কর্মসূচি দেওয়া হবে।
নেতারা আরও বলেন, ভোটের পর অনেকের মধ্যে হতাশা থাকতে পারে। কিন্তু ফের রাজপথে নামায় অনেকটা হতাশা দূর হয়েছে। এখন আগের মতো নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত। আন্দোলনের পাশাপাশি কূটনীতিতেও জোর দেওয়া হচ্ছে। নেতারা মনে করছেন, সরকার মুখে যাই বলুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার অনেক আগেই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করবেন তারা।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি-সংবিধান মেনে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের পরে বিশ্বের প্রায় সব দেশের সরকার প্রধান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা সরকারকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছে। নির্বাচন বর্জন করলেও বিএনপি ও তাদের মিত্ররা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার যে ‘অপচেষ্টা’ করেছে তাতে সফল হতে পারেনি। সব মিলিয়ে নির্বাচনে বিজয়ের পর ফুরফুরে অবস্থানে থাকলেও তাদের সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সামনের দিনে ইশতেহার বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেবে দলটি। এছাড়া বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলায় আগের মতোই ভোটের পরেও রাজপথে সক্রিয় থাকবে দলটি। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মতে-রাজনীতি, অর্থনীতি ও কূটনীতি তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই তিন দিকেই তাদের মনোযোগ রয়েছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য যা যা করার প্রয়োজন তারা তাই করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদ্য ড. মঈন খান বলেন, আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে ভুলে গিয়ে একটি অগণতান্ত্রিক একদলীয় সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। এটা কিন্তু ভারতের নীতিনির্ধারকদের একটি মারাত্মক ব্যর্থতা। এটা তাদের বিবেচনা করা উচিত তারা কিভাবে এ ব্যর্থতা থেকে বেরিয়ে আসবে। দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক দুটি সরকারের মধ্যে হয় না, জনগণের মধ্যে যদি বন্ধুত্ব না থাকে তাহলে সরকারে সরকারে বন্ধুত্ব তাতে কোনো লাভ হয় না। এই মুহূর্তে তাদের যে নীতি তা বাংলাদেশের বেলায় সঠিকভাবে কাজ করছে কি করছে না তা অবিলম্বে বসে বিবেচনাও করা উচিত।
এদিকে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, সারা বিশ্ব নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। ফলে কোনো সংকট থাকবে না।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আমি মনে করি-যে নির্বাচন হয়েছে, সেটা একপেশে নির্বাচন। এ নির্বাচনে জনগণের প্রার্থী পছন্দের সুযোগ ছিল না। বিএনপি সেজন্যই আন্দোলন করছিল। এখন সেখানে বিএনপি সফল হয়েছে নাকি ব্যর্থ হয়েছে সেটা তারা বিবেচনা করবে। তিনি আরও বলেন, বিএনপি সামনের দিনে কি করবে না করবে, সে কৌশল তারাই ঠিক করবে। আমাকে অনেকেই বলে বিএনপি ব্যর্থ। আমি বলি, ব্যর্থ হলে হয়েছে, এটা তাদের দায়। কিন্তু বিএনপি ব্যর্থ হলে জনগণও ব্যর্থ হয়ে যাবে, এটা আমি মনে করি না। আপাতত মনে হতে পারে বর্তমান শাসকের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নেই, কিন্তু আসলে জনগণের রায়, জনমত হিমালয় পর্বতের চেয়েও শক্তিশালী। বঞ্চিত হতে হতে এক সময় জনগণ জেগে উঠবে। এটা ইতিহাসেও লেখা আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হতে হবে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে যে কথাটা বলা হয়েছে, দুর্নীতি করে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনা এবং বাজেয়াপ্ত করা। অর্থাৎ আর্থিক যে অপরাধগুলো হয়েছে, সেখানে গুরুত্ব দিতে হবে। দুর্নীতি দূর করতে পারলে অন্যান্য সমস্যাগুলোও সমাধান করা যাবে। দুর্নীতি না থাকলে সুশাসন নিশ্চিত করাও সম্ভব হবে। ফলে আমার মনে হয় সব দিক থেকে বিবেচনা করলে সরকারের এক নম্বর এজেন্ডা হতে হবে দুর্নীতি দমন এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ সময় দুর্নীতি দূর করতে পারলে সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগের মধ্যে যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিরোধ রয়েছে সেগুলোরও সমাধান হয়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।