স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনস্থ ‘গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে (২য় পর্যায়)’ বিভিন্ন কাজের বিপরীতে টাকা ছাড় নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সেখানে রীতিমতো অবৈধ অর্থ লেনদেনের ‘ছড়াছড়ি’ চলছে। এ যেন এক রকম ‘স্থায়ী সংস্কৃতি’তে পরিণত হয়েছে। যা চলছে বছরের পর বছর। আর এসব অনিয়ম বিরুদ্ধে একজন সহকারী প্রকৌশলী প্রতিবাদ করায় তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। পাশাপাশি অবৈধ লেনদেনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধান এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
জানতে চাইলে প্রকল্পের পিডি সুজায়েত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে অন্তত ১০০ জন আমাকে ফোন দিয়েছেন। যারা ফোন করেছেন তারা বিনা কারণে ধান্ধা খুঁজছেন। প্রকল্প নিয়ে যেসব অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে সেগুলো সঠিক হলে যথাযথ তদন্ত করে নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবেন। তাছাড়া দুদক তো আছেই। তিনি আরও বলেন, নিজেদের মধ্যে রেষারেষির কারণেই এসব জিনিস বাইরে আসছে। যেসব অভিযোগ আসছে, সেগুলো সত্য হলে অভিযুক্তদের ফাঁসি হয়ে যাওয়া উচিত।
জানা গেছে, ২৮১টি পৌরসভা নিয়ে ২০১৮ সালের এপ্রিলে উল্লিখিত প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এটি আগামী বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। শুরুতে প্রকল্পটিতে বরাদ্দ ছিল তিন হাজার ৪৬৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পরে আরও ৯৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকল্পের শুরুতে প্রথম শ্রেণি পৌরসভার জন্য ১৪ কোটি টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণি পৌরসভার জন্য ১০ কোটি এবং তৃতীয় শ্রেণি পৌরসভার জন্য বরাদ্দ ছিল ৮ কোটি টাকা।
এই প্রকল্প ঘিরে গত এক বছরে অবৈধ অর্থ লেনদেনের অন্তত ২০টি কল রেকর্ড যুগান্তরের হাতে এসেছে। কল রেকর্ড বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গাইবান্ধা পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল ইসলাম দুই লাখ টাকার বিনিময়ে এক কোটি টাকার ফান্ড ছাড় করিয়েছেন। এক্ষেত্রে এলজিইডির একজন সহকারী প্রকৌশলী ফোন করেন পৌর নির্বাহী প্রকৌশলীকে। সহকারী প্রকৌশলী জিজ্ঞাস করেন, ফান্ড পেয়েছেন?
উত্তরে পৌর নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ঈদের আগে এক কোটি টাকা পেয়েছি। তার কাছে প্রশ্ন ছিল-এ টাকা পাওয়ার বিনিময়ে কিছু খরচ করতে হয়েছে কিনা? উত্তর ছিল, হিসাবরক্ষক (হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা) তরিকুলকে দুই লাখ টাকা দিয়েছি। পরে সহকারী প্রকৌশলী বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে দুদকে মামলা চলছে। তাই এবার তো টাকা নেওয়ার কথা ছিল না। উত্তরে পৌর নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, আমরা নিরুপায় হয়েই টাকা দিই।
আরেক ঘটনার বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, বিয়ানীবাজার পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী (পাশাপাশি গোলাপগঞ্জ পৌরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত) নিকুঞ্জ ব্যানার্জী পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে দুটি পৌরসভার জন্য আড়াই কোটি টাকা ছাড় করেছেন। এ সংক্রান্ত কল রেকর্ডে সংশ্লিষ্ট সহকারী প্রকৌশলী বলেন, হিসাব ঠিক আছে তো? উত্তরে পৌর নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, একদম ঠিক আছে। দুই ভাগ হারে টাকা দিয়েছি। কন্ট্রাক্টরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রকল্প পরিচালকের অফিসে দিয়েছি। আপনারা বেশি নিচ্ছেন বলেই আমরা স্থানীয় কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করছি।
আরেকটি কল রেকর্ড থেকে জানা যায়, ৫০ লাখ টাকার বিল ছাড় করার আগেই বিকাশে রাকিবুল ইসলামের (সহকারী প্রকৌশলী, আউটসোর্সিং) মাধ্যমে হিসাবরক্ষক তরিকুলের কাছে ৫০ হাজার টাকা বিকাশে পাঠানো হয়। ছাড়কৃত টাকা ক্যাশ হওয়ার পর আরও টাকা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় ফোনের অপর প্রাপ্ত থেকে।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নাটোরের বনপাড়া পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী আতাউর রহমান ছয় লাখ টাকার বিনিময়ে পেয়েছেন তিন কোটি টাকা। এ সংক্রান্ত কথোপকথনে আতাউর বলেন, ‘বরাবরের মতোই দুই শতাংশ টাকা হিসাবরক্ষক তরিকুলকে দিয়েছি। আরও ফান্ড বাকি আছে।’
আরেক ঘটনায় এলজিইডির এক কর্মকর্তার সঙ্গে একই ধরনের কথোপকথন হয় রাজশাহী পুটিয়া পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী শহিদুল আলমের। শহিদুল আলম জানান, তিনি তিন কোটি টাকা ফান্ড পাওয়ার জন্য ছয় লাখ টাকা ঘুস দিয়েছেন। কিন্তু টাকা পেয়েছেন দুই কোটি।