অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় চলতি বাজেট বাস্তবায়নের শুরুতেই টাকা খরচের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ওপর কয়েকটি বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। তা শেষ না হতেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। ফলে উভয় ধাক্কার নেতিবাচক প্রভাবে চলতি বাজেট বাস্তবায়ন (প্রথম প্রান্তিকে) হার গত তিন বাজেটের একই সময়ের তুলনায় কমে গেছে। বাজেট বাস্তবায়ন হার নিয়ে অর্থ বিভাগের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
চলতি এবং বিগত কয়েকটি বাজেটের নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মাত্র ৮৩ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এটি মোট বাজেটের মাত্র ১০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আগের অর্থবছর (২০২২-২৩) প্রথম প্রান্তিকে বাজেটের ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হয়। ওই হিসাবে চলতি বাজেটের বাস্তবায়ন হার গেল বাজেটের তুলনায় কম হয়েছে ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। এছাড়া ২০২১-২২ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের একই সময়ে অর্থ ব্যয়ের হার ছিল ১১ শতাংশ।
জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে জানান. কৃচ্ছ সাধন করে কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় কমিয়েছে ইতোমধ্যে। এর প্রভাব এসে পড়তে পারে। আরেকটি ইস্যু হতে পারে নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে উন্নয়ন খাতেও কম ব্যয় হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যে ব্যয় কমানো হচ্ছে এবং এর প্রভাবে বাজেটের ব্যয় কমছে, সেটি নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে মুদ্রানীতি দিয়ে ব্যয় কমিয়ে আনা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশেও কিছুটা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আছে। তা থাকা সত্ত্বেও রাজস্ব আদায়ের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত আছে। প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আয়, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় এবং ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহসহ মৌলিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোর অবস্থান সন্তোষজনক পর্যায়ে আছে।
সেখানে আরও বলা হয়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যপণ্য এবং জ্বালানির জোগানে বাধাগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নিম্ন প্রবৃদ্ধির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি এখনো নানা ধরনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করছে। সব ধরনের বিরূপ প্রভাব সত্ত্বেও গত অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ অর্জন হয়। যেখানে ২০২৩ সালে বৈশ্বিক গড় প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ এবং উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪ শতাংশ।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের শুরুতে দুটি চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতে সংকট তৈরি, দ্বিতীয়-দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি। শেষ পর্যন্ত দুটি শঙ্কাই বাস্তবে রূপ নিয়েছে বলে মনে করছেন অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকার ব্যয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছে। চলতি হিসাবের ভারসাম্য রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে আমদানির ক্ষেত্রেও প্রবৃদ্ধি কমেছে বিগত অর্থবছরের তুলনায় ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। বর্তমান বিলাসদ্রব্য পণ্য আমদানি পরিহার এবং মিত্যব্যয়ের কারণে এ খাতে খরচ হ্রাস পেয়েছে।
বাজেটের অর্থের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে। কিন্তু এ বছর উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ে তেমন কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব এক্ষেত্রে পড়েছে। প্রতিবেদনে দেখানো হয়, প্রথম প্রান্তিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বাস্তবায়ন হার ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ।
সর্বশেষ তথ্য মতে, এডিপির বাস্তবায়ন হার জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে ৬১ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ আইএমইডি এ তথ্য জানায়, গত এক দশকের তুলনায় এ বাস্তবায়ন হার সবচেয়ে কম।
সংশ্লিষ্টদের মতে, গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আহরণ ২৩ হাজার কোটি টাকা কমেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধিও কমছে। তবে অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের হিসাব তুলে ধরে বলা হয়, এই সময়ে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ। কিন্তু গত অক্টোবর-ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি কম ছিল। নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল ও অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। রাজপথে জালাও-পোড়াও ছিল চোখে পড়ার মতো। বাস, ট্রাক ও রেলে ঘটছে অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা। ফলে ব্যাহত হয় স্বাভাবিক আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম। ব্যাহত হয় পাইকারি ও খুচরা ব্যবসাসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমও। এমনিতে ডলার সংকটের এলসি খোলার জটিলতায় পণ্য আমদানি খাতকে সংকুচিত করেছে। অপরদিকে বিগত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়ায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও প্রভাব ফেলছে রপ্তানি কার্যক্রমে ওপর। অবরোধসহ নানা কর্মসূচির কারণে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় অনেকটা স্থবিরতা নেমে আসে। ফলে এসব খাত থেকে কমেছে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আদায়। যে কারণে প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আদায় ভালো থাকলেও দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা কমে আসে।
রপ্তানি আয় সম্পর্কে অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে ধনাত্মক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। যা জানুয়ারি মাসে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশে।