রপ্তানিকারকদের জন্য বড় সুযোগ, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার তাগিদ
বিশ্বব্যাপী অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পোশাকের বাজার বড় হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে শুধু অনলাইন বাজারে প্রায় ৩১ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক আমদানি-রপ্তানি করবে বিভিন্ন দেশ। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য হিসেবে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সামনে বড় সুযোগ অপেক্ষা করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক মানের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ভার্চুয়াল মার্কেট প্লেস স্থাপনের সম্ভাব্যতা গবেষণা প্রকাশ করেছে পোশাক মালিকদের বড় সংগঠন বিজিএমইএ। ওই গবেষণায় বলা হয়- ২০২৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আফ্রিকায় তৈরি পোশাকের অনলাইন বাজার বেড়ে ৩০ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়াবে। আর ২০২৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর বাজারে পোশাক বিক্রির এক-তৃতীয়াংশই অনলাইনে স্থানান্তরিত হবে। এতে গতানুগতিক রপ্তানির বাইরে বাড়তি প্রায় আরও ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানির সুযোগ রয়েছে দেশের সামনে।
বিজিএমইএর পক্ষে এ গবেষণা করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসল পার্টনারস। এতে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) পার্টনারশিপ ফর ক্লিনার টেক্সটাইল (প্যাক্ট টু) প্রোগ্রাম। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পোশাক চার দশক ধরে সফলভাবে কাজ করলেও নিজস্ব ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এটির পরিবর্তন করতে চাই। আমরা নিজেদের ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হতে পারে আমাদের জন্য একটি কৌশলগত এন্ট্রি পয়েন্ট।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে দেশীয় বাজারের জন্য জাতীয় ডিজিটাল নীতিমালা তৈরি হলেও আন্তর্জাতিক ই-কমার্সে প্রবেশ করার জন্য কোনো সুস্পষ্ট নীতি-কাঠামো করা হয়নি। তিনি জানান, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী ফ্যাশনের মোট বিক্রির ১৮ শতাংশ ভার্চুয়াল মাধ্যমে হয়েছিল। সেটি আগামী ২০২৫ সালে ২৩ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে কার্যকর ডিজিটাল মার্কেট প্লেস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা বৈশ্বিক পেমেন্ট গেটওয়ের অনুপস্থিতি, চলতি মূলধন অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ, ছোট ছোট ক্রয়াদেশ প্রক্রিয়াজাত করার জটিল প্রক্রিয়া ইত্যাদি রয়েছে।
এ ছাড়া দেশীয় বাজারের জন্য জাতীয় ডিজিটাল নীতিমালা তৈরি হলেও আন্তর্জাতিক ই-কমার্সে প্রবেশ করার জন্য কোনো সুস্পষ্ট নীতি-কাঠামো তৈরি করা হয়নি। এসব বিষয়ের সমাধান করতে হলে একটি আন্তর্জাতিক মানের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাবিশ্বে যেভাবে অনলাইনে পোশাক আমদানি-রপ্তানি বাড়ছে, সেখানে সঠিকভাবে বাংলাদেশ নিজেদের মেলে ধরতে না পারলে ভবিষ্যতে এ খাত অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই এখনই নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে সম্প্রতি এই গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন লাইটক্যাসল পার্টনারসের কর্মকর্তা দিপা সুলতানা। তিনি বলেন, ২০২৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আফ্রিকায় তৈরি পোশাকের ভার্চুয়াল বাজার বেড়ে ৩০ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়াবে। আর ২০২৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র্র ও ইইউর বাজারের পোশাক বিক্রির এক-তৃতীয়াংশই অনলাইনে স্থানান্তরিত হবে।
প্রতিবেদন প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গার্মেন্টস খাতের উদ্যোক্তারা জানান, করোনার সময় যখন পোশাক রপ্তানির আদেশ বাতিল হচ্ছিল আর বাজারগুলোতে অনলাইন ব্যবসা বাড়ছিল, তখন এই মার্কেটে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রথাগত ব্যাংকিং ও কাস্টমস নিয়ম-নীতি ভার্চুয়াল বাজারের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অর্থাৎ বেশ কিছু বিধি-বিধান বিশেষ করে, ব্যাংকিং ও কাস্টমস নিয়ম-নীতি সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। তা ছাড়া ভার্চুয়াল বাজার যেহেতু একটি নতুন বিষয়, তাই শিল্পের ভেতরে কিছু প্রস্তুতি ও সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করা ও যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অনলাইন পোশাকের বাজারের মাত্র দশমিক ২০ শতাংশ, ইইউর দশমিক ১০ শতাংশ এবং আফ্রিকার দশমিক ৭৫ শতাংশ হিস্যা নিতে পারলেই ৪৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার মূল্যের অতিরিক্ত তৈরি পোশাক রপ্তানি করা সম্ভব, যা ডলারের বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী ৫ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকার মতো। লাইটক্যাসলের প্রতিবেদনে ভার্চুয়াল মাধ্যমে ব্যবসা থেকে ব্যবসা (বি টু বি) এবং ব্যবসা থেকে ভোক্তার এই দুই ক্ষেত্রে সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ভার্চুয়াল মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণের ফলে নতুন বাজার ও ক্রেতার সন্ধান মিলবে। তাতে ব্যবসার পরিমাণ বাড়বে।
এদিকে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশের রয়েছে চারটি স্তম্ভ- স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ। স্মার্ট অর্থনীতিরই একটি ধাপ হচ্ছে অনলাইন বাজার।
এই অর্থনীতিতে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, নারী-পুরুষ, শিক্ষা অথবা ভৌগোলিক দূরত্ব নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে। এতে অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানি বাজার সম্প্রসারিত হবে। তথ্যপ্রযুক্তি সহযোগে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে নেওয়া যাবে ত্বরিত ও তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, সারাবিশ্বেই দিন দিন অনলাইন বাজার বড় হচ্ছে। নিজেদের প্রয়োজনে মানুষ ভার্চুয়াল জগতে কেনাকাটা ও নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারছেন। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও বিষয়টি জোরেশোরে বলা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছেÑ সরকার তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সারাবিশ্বের সঙ্গেই ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। যদিও দেশে ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা নিয়ে ব্যাপক প্রতারণা এবং এর পাশাপাশি কঠোর সমালোচনাও রয়েছে। এরপরও বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ই-কমার্স খাতকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় আমরা পিছিয়ে পড়তে পারি। তিনি বলেন, অনলাইনে পোশাক রপ্তানির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্পূর্ণ বিতর্কের ঊর্ধ্বে যাতে অনলাইনে পোশাক রপ্তানি করা যায়, সেজন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে।
অনলাইন মার্কেট প্লেসের মাধ্যমে বেঁধে দেওয়া সময় ও ব্যবসার খরচ কমবে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া আরও সহজ হবে। এ ছাড়া অনলাইনে রপ্তানি কার্যক্রম বাড়লে ধীরে ধীরে মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যাও কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি শেষ পর্যন্ত ব্যবসাকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে সক্ষম হবে মনে করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান আরও বলেন, দেশি পোশাক সরবরাহকারীরা অনলাইন মার্কেট প্লেসের মাধ্যমে পাইকার, খুচরা বিক্রেতা, ব্র্যান্ড এমনকি ক্রেতাদের কাছে সরাসরি পণ্য বিক্রি করতে পারেন। এটি ব্যবসায়ীদের ভালো দাম পেতে সহায়তা করবে। বর্তমানে অ্যামাজন ও আলিবাবার অনলাইন মার্কেট প্লেস আছে এবং বাংলাদেশ থেকে তাদের গ্রাহকদের কাছে পণ্য সরবরাহ করে।
তিনি বলেন, বিদায়ী বছরে (২০২৩) পোশাক রপ্তানি ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। এর আগের বছর বৈশ্বিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে আমাদের হিস্যা ছিল ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আশা করছি, ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের এই হিস্যা ১২ শতাংশে নিয়ে যেতে পারব। এর জন্য নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন এবং তা কাজে লাগাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লাতিন আমেরিকায় বড় হচ্ছে রপ্তানি বাজার ॥ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় রপ্তানি বাজার হচ্ছে লাতিন আমেরিকা। এই অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতির দুই দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সুবিধার্থে সম্প্রতি বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ দূতাবাস স্থাপন করেছে। লাতিন আমেরিকার ২৫টির বেশি দেশের ৬৬ কোটি ভোক্তার বাজারে ৩৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পোশাক ব্যবসায়ীরা ভালো করছেন। ঢাকায় কয়েকটি দেশের দূতাবাস খোলা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং চিলি বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ায় লাতিন আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশী পণ্য রপ্তানিতে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানি ২০ দশমিক ৫১ শতাংশ বেড়ে ৬২১ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা ছিল ৫১৫ দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলার।
এ প্রসঙ্গে লাতিন আমেরিকা-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আনোয়ার শওকত আফসার বলেন, কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশ থেকে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানি পরিমাণ খুবই কম ছিল। তিনি বলেন, এখন যোগাযোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানির পরিমাণও দ্রুত বাড়ছে। তিনি জানান, লাতিন আমেরিকায়ও ধীরে ধীরে অনলাইন ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে দ্রুত রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ করতে পারে।