দেশের ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে রোডম্যাপ বা পথনকশা ঘোষণা করে তা বাস্তবায়ন শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ভালো অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বেসরকারি খাতের প্রাইম ব্যাংকের সঙ্গে আগামী সপ্তাহে একীভূত হতে যাচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে সম্মতিও দিয়েছে। দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যাংক পরিচালক হওয়ার ক্ষেত্রেও শর্ত কঠিন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার ন্যূনতম বয়স হবে ৩০ বছর। আবার একজনের নামে শেয়ার কিনে আরেকজনকে প্রতিনিধি পরিচালক করা যাবে না। আদালতের পাশাপাশি এখন থেকে কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাধ্যমে দ-িত ব্যক্তি পরিচালক হতে পারবেন না। একইসঙ্গে ৪৫ বছর বয়সের আগে কেউ ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হতে পারবেন না। সর্বোচ্চ ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত এ পদের দায়িত্ব পালন করা যাবে। এ ছাড়া আগামী মাস থেকে খেলাপি ঋণ কমানো এবং জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ শূন্যে নামিয়ে আনার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় রোডম্যাপ বা পথনকশা ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই পথনকশা ঘোষণার আগে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সম্মতিও নেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারেও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও অপরাধ দমন, খেলাপি ঋণ বারবার পুনর্তফসিল করে ঋণ নেওয়ার সুযোগ নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রভাবমুক্ত রাখার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পথনকশায় ১৭টি বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলো খেলাপি ঋণ কমানো, বেনামি ঋণ ও জালিয়াতি বন্ধ করা, যোগ্য পরিচালক নিয়োগে ব্যবস্থা, উপযুক্ত স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ এবং দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা, যাকে মার্জার বলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, তাদের লক্ষ্য তিনটি। এক. ব্যাংকের সার্বিক খেলাপি ঋণ আট শতাংশের নিচে নামানো, যা এখন ১০ শতাংশের কিছু কম। দুই. রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ এবং বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনা, যা এখন যথাক্রমে প্রায় ২২ ও ৭ শতাংশ। ও তিন. ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে সীমার বাইরে দেওয়া ঋণ, বেনামি স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণ এবং জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ শূন্যে নামিয়ে আনা। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব লক্ষ্য পূরণের সময়সীমা ঠিক করেছে ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সবার আগে দুর্বল ব্যাংকগুলোতে স্বাধীনভাবে বিশেষ নিরীক্ষা চালাতে হবে। তার আগে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সংস্কার কাজটি কঠিনভাবে করতে হবে। তবে সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা কতটা থাকবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পথনকশায় ব্যাংক একীভূত করার বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, একীভূত হওয়ার তিন বছর পর্যন্ত কাউকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না। ব্যাংকে পেশাদারদের নিয়োগে একাধিক পদক্ষেপের কথাও বলা হয়েছে। পথনকশায় অপেক্ষাকৃত সবল কোম্পানির সঙ্গে দুর্বল কোম্পানির একীভূতকরণের উদ্যোগ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই তা বাস্তবায়ন শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রথম উদ্যোগ হিসেবে বেসরকারি খাতের প্রাইম ব্যাংকের সঙ্গে আগামী সপ্তাহে একীভূত হতে যাচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে সম্মতিও দিয়েছে। এখন দুই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ ও নীতিনির্ধারকেরা বসে একীভূত কার্যক্রমের পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
জানা গেছে, এরই মধ্যে প্রাইম ব্যাংকের বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা ইউনিয়ন ক্যাপিটালে অর্থও বিনিয়োগ করেছেন। প্রাথমিকভাবে ঋণ হিসেবে এ অর্থ প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া হয়েছে। একীভূত কার্যক্রম প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হলে এ ঋণ মূলধন হিসেবে রূপান্তর হবে। প্রাইম ব্যাংকের সঙ্গে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের একীভূত হওয়ার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বেসরকারি খাতের কোম্পানি ইস্টকোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রাইম ব্যাংকের পরিচালক আজম জে চৌধুরী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের পক্ষ থেকে একীভূত হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে। এখন দুই প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মিলে কীভাবে একীভূত কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে, সেটি নির্ধারণ করবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বেশ আগে থেকে প্রাইম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার চেষ্টা করে আসছে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। এতদিন নীতিমালা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে সাড়া দেয়নি। এখন সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে একীভূতকরণের সায় পাওয়া গেছে। কয়েকটি ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে তিনি জানান। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসির সঙ্গে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক যুক্ত হয়ে যেভাবে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছে, সেই আদলেই ইউনিয়ন ক্যাপিটালের সঙ্গে যুক্ত হবে প্রাইম ব্যাংক। সেক্ষেত্রে একে অপরের সহযোগী হয়ে দুই প্রতিষ্ঠান আলাদা আলাদা কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দেশে অনেক দুর্বল ব্যাংক আছে সেগুলো একত্র করা যায় কি না দেখতে হবে। জোর করে করতে গেলে অন্য বেসরকারি ব্যাংক এর দায় নেবে না। সরকারি ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতির বোঝাটা সুদহারের যে ফারাক তা বেড়ে গিয়ে পুরো অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবেই হোক সাহায্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে, সে ক্ষতি তো সারা দেশকেই কোনো না কোনোভাবে নিতে হয়। আশির দশকে যখন বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল তখন যে ভুলটা করা হয়েছিল, এখনো সেই ভুল করা হচ্ছে। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বেসরকারি খাতের ব্যাংককে অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু যে নিয়মকানুন দরকার সেই নিয়মের কথা চিন্তা করিনি। সেজন্য তারা (বেসরকারি ব্যাংক শেয়ারধারী) বলেছিল ব্যাংক দিয়েছি টাকা নেওয়ার জন্য। সেই ভুল আবারও যেন না করি। কিছু বছর ধরে বলা হচ্ছে যে মুক্ত অর্থনীতির যুগে যে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান শেয়ার কিনে তো অধিগ্রহণ করতে পারে। কাজেই সেটা করাই যায়, ব্যাংকের শেয়ার কিনে মালিকানা দখল করা যায়। কিন্তু আমরা যে ভুলটা করছি বা করে ফেলছি সেটি হলো ব্যাংকের মতো একটা সংবেদনশীল খাতে কয়েকটি কারণে একটি পরিবারের হাতে মালিকানা চলে যাচ্ছে একাধিক ব্যাংকের। তবে অবশ্যই ব্যাংক খাত উন্নত হচ্ছে, ডিজিটাল হয়েছে এটাও ঠিক।
এদিকে দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যাংক পরিচালক হওয়ার ক্ষেত্রেও শর্ত কঠিন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত রবিবার ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ গঠন এবং পরিচালকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যসংক্রান্ত ২৪ পৃষ্ঠার একটি পরিপত্র জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই পরিপত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংকের কর্মকা- প্রধানত আমানতকারীদের অর্থে পরিচালিত হয় এবং এক্ষেত্রে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা অপরিহার্য। বাংলাদেশ ব্যাংক উল্লেখ করেছে, ব্যাংকের সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন, ব্যবসায়িক কার্যক্রম যথাযথ ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পেশাগতভাবে দক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হওয়া আবশ্যক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে ২০২৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইনে অধিকতর সংশোধনী আনা হয়। এই সংশোধনের ফলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের গঠন ও পরিচালকদের দায়িত্ব কর্তব্য যোগ্যতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নতুনভাবে নীতিমালা প্রণয়ন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালক পদে নিযুক্ত হওয়ার জন্য যেসব যোগ্যতা ও উপযুক্ততা নির্ধারণ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ফৌজদারি অপরাধে দ-িত হতে পারবেন না, কিংবা কোনো জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্য অবৈধ কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, বা জড়িত নন, এমন নিশ্চয়তা থাকতে হবে। তার সম্পর্কে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলায় আদালতের রায়ে বিরূপ পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য থাকলে চলবে না, আর্থিক খাত-সংশ্লিষ্ট কোনো নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের বিধিমালা, প্রবিধান, নীতিমালা বা নিয়মাচার লঙ্ঘনের কারণে দ-িত হওয়া যাবে না।
ওই নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালক হতে আগ্রহী ব্যক্তিকে এমন হতে হবে যে তিনি কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, যার নিবন্ধন বা লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে, বা প্রতিষ্ঠানটি অবসায়িত হয়েছে। তার নিজের কিংবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের জন্য খেলাপি নন। ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালক হতে গেলে অন্য কোনো ব্যাংক-কোম্পানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানি বা তেমন কোম্পানিগুলোর কোনো সাবসিডিয়ারি কোম্পানির পরিচালক বা উপদেষ্টা বা পরামর্শক বা অন্য কোনোভাবে লাভজনক পদে নিয়োজিত থাকা যাবে না। এ ছাড়া তিনি একই ব্যাংক-কোম্পানির বহির্হিসাব নিরীক্ষক, আইন উপদেষ্টা, উপদেষ্টা, পরামর্শক বা অন্য কোনো লাভজনক পদে থাকতে পারবেন না।