ব্যাংক একীভূতকরণের ফলে বিলুপ্ত হতে পারে-এমন ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের সম্পদ বিক্রির নামে আবার লুটপাটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ দফায় পানির দরে খেলাপিদের সম্পদ বিক্রির নামে একটি চক্র তা হাতিয়ে নিতে পারে। আইনের ফাঁক গলিয়ে পানির দরে মূল্যবান সম্পদ হাতিয়ে নিতে পরিকল্পনাও করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর আগেও ঋণখেলাপিদের সম্পদ নিলামের মাধ্যমে পানির দরে বিক্রির নজির রয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও দরপত্রদাতার মধ্যে আগে থেকেই একটি সমঝোতা হয়ে থাকে। এ সমঝোতার আড়ালে বন্ধকি সম্পদ পানির দরে হস্তান্তর হয়। এদিকে ঋণখেলাপিদের সম্পদ দ্রুত বিক্রি করে টাকা আদায়ের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের নীতিমালা তৈরি করছে। ইতোমধ্যে এর একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এতেও অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানির একীভূতকরণ প্রক্রিয়া চলমান। এ বিষয়ে ৪ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানি একীভূত করার একটি নীতিমালা জারি করেছে। এই নীতিমালার আওতায় সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানি একীভূত হতে পারবে। ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলো নিজেরাই একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ডিসেম্বরের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে কোনো সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানিকে একীভূতকরণের নির্দেশনা দিতে পারবে।
প্রসঙ্গত, বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে লুটপাটে দুর্বল হয়ে পড়া অপর বেসরকারি পদ্মা ব্যাংক। সরকারি সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত সরকারি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে লুটপাটে দুর্বল হওয়া সরকারি খাতের বেসিক ব্যাংক। এটি অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। বেসরকারি ইউসিবির সঙ্গে একীভূত হবে লুটপাটে দুর্বল হওয়া বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক। এছাড়া আরও কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
সূত্র জানায়, একীভূতকরণের ফলে দুর্বল ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানিটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে সবল ব্যাংকের সঙ্গে। এ প্রক্রিয়ায় সবল ব্যাংকের আর্থিক সূচকে কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রথমেই আর্থিক ভিত্তি শক্ত করতে সবল ব্যাংক বিলুপ্ত ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানির ঋণখেলাপিদের বন্ধকি সম্পদ বিক্রি করে নগদ টাকা আদায়ের উদ্যোগ নেবে। ঋণের বিপরীতে অনেক খেলাপির জমি, বাড়ি, বন্ধ কারখানার জমিসহ নানা সম্পদ বন্ধক রয়েছে। এগুলো এখন পানির দরে বিক্রি করে আবার লুটপাটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনিতেই বিলুপ্ত ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলো লুটপাটের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন বিলুপ্ত হয়েও লুটপাটের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। অতীতেও বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের সম্পদ পানির দরে বিক্রির নজির পাওয়া গেছে। একটি সরকারি ব্যাংক, কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক খেলাপিদের সম্পদ পানির দরে বিক্রি করে গোপন সমঝোতার মাধ্যমে একটি চক্রের হাতে তুলে দিয়েছে। এর বিপরীতে ব্যাংকের ঋণ সমন্বয় হয়েছে। কিন্তু সম্পদের দাম আরও বেশি ছিল। এ প্রসঙ্গে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, একটি বন্ধকি সম্পদ কয়েক দফা দরপত্র দিয়েও নায্য দামে বিক্রি করতে পারিনি। কারণ, যিনি মালিক, তার ভয়ে কেউ দরপত্র জমা দেয় না।
সূত্র জানায়, এখন ঋণখেলাপিদের বন্ধকি বা অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা আদায়ে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করার একটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কোম্পানির মাধ্যমে বন্ধকি সম্পদ দ্রুত বিক্রি করে ব্যাংক টাকা আদায় করতে পারবে। ওই নীতিমালার আওতায় অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করতে হবে। এখন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি কারা গঠন করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ব্যাংকে যারা লুটপাট করেছে তারা যদি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে থাকে, তাহলে লুটপাটের আশঙ্কা আরও বাড়বে। এদিকে সম্ভাব্য নীতিমালাটি এমনভাবে করা হচ্ছে, যেটিতে ব্যাংক লুটেরাদের বাদ দেওয়ার সুযোগ থাকছে না। এ সুবাদে ব্যাংক লুটেরারা আবার বন্ধকি সম্পদে ভাগ বসাতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেছেন, নীতিমালাটি এমনভাবে করা উচিত যাতে কোনো ব্যাংক লুটেরা, ঋণখেলাপি, ব্যাংক বা সরকারি টাকা আত্মসাতের নজির রয়েছে-এমন কোনো ব্যক্তি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে অংশ নিতে না পারে। ব্যাংক নিলামকারীদের মধ্যে আপসরফার মাধ্যমে বন্ধকি সম্পদ বিক্রি হচ্ছে। এতে ব্যাংক ঠকে যাচ্ছে। লাভবান হচ্ছে একটি চক্র। এ চক্রটি চিহ্নিত। তারা যাতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে থাকতে না পারে, সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে।
তিনি আরও বলন, একবার লুট হয়ে ব্যাংক দুর্বল হয়েছে। এখন সম্পদ বিক্রির ক্ষেত্রে যাতে কোনো লুটপাট না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে।
এছাড়া ব্যাংক প্রচলিত অর্থঋণ আদালত আইনে মামলা ছাড়াই খেলাপির বন্ধকি সম্পদ বিক্রি করতে পারবে। এতে ব্যাংকের টাকা আদায় না হলে খেলাপির অন্য সম্পদ বিক্রি করেও টাকা আদায়ের জন্য মামলা করতে পারবে। এ প্রক্রিয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছে-বন্ধকি সম্পদ বা অন্য সম্পদ পানির দরে বিক্রি করে নতুন করে আবার লুটপাট করার পরিকল্পনা চলছে।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যেই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের জন্য একটি চক্র তৎপরতা শুরু করেছে। এর মধ্যে খ্যাতিমান কোনো অডিট বা সম্পদ মূল্যায়ন কোম্পানির ব্যক্তিরা নেই। তারা সবই পরোক্ষভাবে ব্যাংক লুটেরা। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্ভাব্য নীতিমালার আলোকে প্রস্তুতি নিচ্ছে। যাতে নীতিমালাটি হলেই দ্রুত এ কোম্পানি গঠন করতে পারে। ফলে দ্রুত সম্পদ বিক্রির নামে পছন্দের চক্রের হাতে তুলে দিতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় লাভবান হবে উভয়েই। কারণ, বন্ধকি সম্পদ বিক্রির দরপত্র এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে চক্রের সদস্য ছাড়া অন্য কেউ অংশ নিতে না পারে। এভাবেই বেশির ভাগ ব্যাংকের বন্ধকি সম্পদ বিক্রি হচ্ছে। বিলুপ্ত ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানির সম্পদও একইভাবে বিক্রির আয়োজন চলছে। এভাবে সম্পদ হাতছাড়া হলে একীভূত হওয়ার পরও ব্যাংক সবল হওয়ার পরিবর্তে দুর্বল হয়ে পড়বে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, সম্পদ বিক্রির ক্ষেত্রে যাতে স্বচ্ছতা বজায় থাকে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজর রাখবে। কোনা অনিয়ম হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা যায়, দেশে বর্তমানে ব্যাংক রয়েছে ৬১টি এবং ফাইন্যান্স কোম্পানি ৩৪টি। একীভূতকরণের মাধ্যমে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানির সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে।