২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ০৫:০৫:৪০ পূর্বাহ্ন
তীব্র গরমে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসমস্যা ও চিকিৎসা
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৪-২০২৪
তীব্র গরমে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসমস্যা ও চিকিৎসা

বৈশাখের প্রচণ্ড গরমে চারদিক অস্থির। সেই সঙ্গে রয়েছে বাতাসে অস্বাভাবিক আর্দ্রতা। বেশ কিছুদিন বৃষ্টি না থাকার কারণে প্রচণ্ড গরমে সবার অবস্থা নাজেহাল। সারা দেশে এখন গরমের দাবদাহে জীবন ওষ্ঠাগত এবং জনজীবন বিপর্যস্ত। এ গরমে শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। গরমে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কী করতে হবে সেটা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ।


গরমে বাড়ছে স্বাস্থ্য সমস্যা। ঘামাচি কিংবা পানি স্বল্পতার মতো সমস্যা প্রায় প্রত্যেকেরই হচ্ছে, আবার কেউ কেউ হিট স্ট্রোকের মতো মারাত্মক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এর সঙ্গে হতে পারে অবসাদ, অ্যালার্জি, সূর্যরশ্মিতে ত্বক পুড়ে যাওয়া, হজমের সমস্যায় বমি বা ডায়রিয়াজনিত রোগ ইত্যাদি।


* শরীরের ওপর দাবদাহের প্রভাব


মাত্রাতিরিক্ত গরমের কারণে যখন শরীরের তাপমাত্রা-নিয়ন্ত্রকগুলোর কার্যক্ষমতা কমে যায়, তখন দুর্বলতা বা ক্লান্তি, মাথাব্যথা, মাথাঘোরা, অবসাদ, কাজকর্মে অনীহা এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে হলে হিট স্ট্রোকের আশঙ্কা থাকে।


* পানিস্বল্পতা বা ডিহাইড্রেশন


গরমের কারণে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যা হয় তা হলো পানিস্বল্পতা। প্রচুর ঘামের কারণে পানির সঙ্গে সঙ্গে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় লবণও বেরিয়ে যায়। এর ফলে শরীরের রক্তচাপ কমে যায়, দুর্বল লাগে, মাথা ঝিমঝিম করে। পানিস্বল্পতা গরমের খুব সাধারণ সমস্যা হলেও অবহেলা করলে তা মারাত্মক হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি, যারা বাইরে অতিরিক্ত গরমের মধ্যে কাজ করেন এবং প্রয়োজনমতো পানি পান করার সুযোগ পান না, তারাই মারাত্মক ধরনের পানিস্বল্পতায় আক্রান্ত হন। এক্ষেত্রে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং কিডনি বিকল হওয়ার মতো জটিলতর সমস্যা হওয়াও বিচিত্র নয়।


* চর্মরোগ, ঘামাচি এবং অ্যালার্জি


গরমের কারণে ত্বকে ঘামাচি এবং অ্যালার্জি হতে পারে। অতিরিক্ত ঘাম তৈরি হয়ে ঘর্মগ্রন্থি ও নালি ফেটে যায়, ফলে ত্বকের নিচে ঘাম জমতে থাকে। এটাই ঘামাচি। অনেক সময় ঘাম ও ময়লা জমে ঘর্মনালির মুখ বন্ধ হয়ে যায় এবং সেখানে ইনফেকশন হতে পারে। এতে ঘামাচি ও অ্যালার্জি বেড়ে যায় এবং ঘামে প্রচুর গন্ধ হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও ঘাম ও ময়লার কারণে ছত্রাকজনিত রোগও এ সময় বেশি হয়। গরমে যারা সরাসরি সূর্যের আলোর নিচে বেশিক্ষণ থাকেন, তাদের ত্বক পুড়ে যেতে পারে। এতে ত্বক লাল হয়ে যায়, জ্বালাপোড়া করে, চুলকায় এবং ফোসকা পড়ে। একে সান বার্ণ বলে। মূলত সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিই এর জন্য দায়ী। যারা একটু ফর্সা বা যাদের ত্বক নাজুক, তাদের এ সমস্যা বেশি হয়।


* হিট স্ট্রোক বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া


গরমের সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হলো হিট স্ট্রোক। হিট স্ট্রোকের শুরুতে হিট ক্র্যাম্প দেখা দেয় যাতে শরীর ব্যথা করে, দুর্বল লাগে এবং প্রচণ্ড পিপাসা পায়। পরে হিট এক্সহসশন দেখা দেয়। এতে শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়, মাথাব্যথা করে এবং রোগী অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকে। এ অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে হিট স্ট্রোক হতে পারে। এর লক্ষণগুলো হলো তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়, ঘাম বন্ধ, ত্বক শুষ্ক ও লাল হয়ে যায়, নিশ্বাস দ্রুত, নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়, রক্তচাপ কমে যায়, খিঁচুনি হয়, মাথা ঝিম ঝিম করে এবং রোগী অসংলগ্ন ব্যবহার করতে থাকে। রোগীর প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়, অজ্ঞান হয়ে যায়, এমনকি রোগী শকেও চলে যেতে পারে।


* বেশি আর্দ্রতাজনিত সমস্যা


তাপদাহের সময় আর্দ্রতা বেশি থাকলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে। ঘাম বের হলে শরীর ঠান্ডা হয়। তবে আর্দ্রতা বেশি থাকলে ঘাম বের হতে পারে না। ফলে দেহের তাপমাত্রা বেড়ে অস্বস্তিকর সমস্যার সষ্টি হয়।


* মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি


শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি তীব্র গরমে অনেকের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। প্রচণ্ড গরমে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় যেটা তীব্র মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের সৃষ্টি করে।


* ফুড পয়জনিং এবং পেটের পীড়া


অনেকেই গরমে তৃষ্ণা মেটাতে বাইরে বা রাস্তাঘাটে বিক্রেতাদের কাছ থেকে অবিশুদ্ধ পানি বা শরবত খান। ফলে ডায়রিয়া ও বমিতে আক্রান্ত হতে পারেন। একই কারণে এ সময়টাতে পানিবাহিত রোগ যেমন-টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, আমাশয়, জন্ডিস বা হেপাটাইটিস বেশি হয়। গরমে অনেকে প্রচুর পানি পান করেন, কিন্তু তাতে পর্যাপ্ত লবণ থাকে না। ফলে শরীরে লবণের অভাব দেখা দেয়। এ অবস্থায় ওর স্যালাইন ও টাটকা ফলের শরবত খাওয়া যায়। অতিরিক্ত গরমে অনেক সময় খাবার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই খাবার খেলে বদহজমসহ অন্যান্য পেটের পীড়া দেখা দিতে পারে।


* কারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন


তাপদাহের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন বয়স্ক, শিশু বিশেষ করে যাদের বয়স পাঁচ বছরের কম। শারীরিকভাবে অসুস্থ যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার, হার্টের বা ক্যানসারের রোগী এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। যেমন-কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক। খেলোয়াড়দের ঝুঁকির মাত্রা দ্বিগুণ। কারণ, শরীরচর্চার কারণেও তাপমাত্রা বেড়ে যায়। গৃহহীন মানুষেরা গরমের কারণে অনেক ঝুঁকিতে থাকেন। কারণ, তাদের জন্য গরম এড়িয়ে চলার সুযোগ কম।


* সুস্থ থাকার জন্য যা করতে হবে


▶ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাবেন না। যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকতে চেষ্টা করুন।


▶ বাইরে বের হলে সরাসরি রোদ যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনে মাথায় কাপড়, টুপি বা রঙয়ের ছাতা ব্যবহার করতে হবে। পরনের কাপড় হতে হবে হাল্কা, ঢিলেঢালা, সুতি কাপড়। শরীর যতটা সম্ভব ঢেকে রাখতে হবে। লিপজেল ব্যবহার করা যায়। বাইরে বেরোনোর পূর্বে ১৫ এসপিএফের উপর সানস্ক্রিন শরীরের উন্মুক্ত স্থানে লাগাবেন। এর ফলে সান বার্ণ থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে।


▶ যারা মাঠে-ময়দানে কাজ করেন তারা ছাতা ব্যবহার করবেন। মাঝেমধ্যে শীতল স্থান বা গাছের নিচে হলেও বসার চেষ্টা করবেন।


▶ কিছু কিছু শিল্প কারখানায় প্রচুর গরমের মধ্যে কাজ করতে হয়। তারাও মাঝেমধ্যে গরম থেকে কিছু সময়ের জন্য বাইরে আসার চেষ্টা করবেন।


▶ প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল পান করতে হবে। যেহেতু ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ বের হয়ে যায়, তাই লবণযুক্ত পানীয় যেমন স্বাভাবিক পানিতে খাবার লবণ মেশাতে পারেন অথবা খাবার স্যালাইন পান করতে পারেন। অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে হবে।


▶ চা ও কফি যথাসম্ভব কম পান করা এবং গরমের সময়ে শরীরচর্চা করা উচিত নয়।


▶ প্রয়োজনমতো গোসল করতে হবে এবং শরীর ঘাম ও ময়লামুক্ত রাখতে হবে।


▶ শ্রমসাধ্য কাজ যথাসম্ভব কম করতে হবে। এক্ষেত্রে কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম নিতে হবে ও প্রচুর পানি ও স্যালাইন পান করতে হবে।


▶ গুরুপাক খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। সহজপাচ্য খাবার যেমন ভাত, ডাল, সবজি, মাছ খাওয়াই ভালো।


▶ খাবার যেন টাটকা হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। নানা রকম ফল যেমন আম, তরমুজ এবং লেবুর শরবত শরীরের প্রয়োজনীয় পানি ও লবণের ঘাটতি মেটাবে।


▶ শিশুদের বেলায় আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। বাচ্চারা যাতে এ সময়টাতে স্কুলে গিয়ে বাইরে খেলাধুলা, দৌড়াদৌড়ি না করে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় যথেষ্ট পানি সঙ্গে দিন। ফুলপ্যান্টের বদলে হাফপ্যান্ট পরাতে পারেন।


▶ বয়স্কদের বেলায় বিশেষ করে যাদের অন্যান্য রোগ আছে তারা যতদূর সম্ভব রোদে চলাফেরা এড়িয়ে চলুন।


▶ সিন্থেটিক জাতীয় কাপড় পরিহার করতে হবে।


▶ গরমে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে দৈনিক ৮ ঘণ্টা ঘুম দরকার। অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও উদ্বেগ ম্যানেজ করতে হয়।


* কেউ অসুস্থ হলে কী করবেন


▶ রোগীকে দ্রুত শীতল কোনো স্থানে নিয়ে যেতে হবে।


▶ ফ্যান বা এসি ছেড়ে দিতে হবে, সম্ভব না হলে পাখা দিয়ে বাতাস করতে হবে।


শেয়ার করুন