গাইবান্ধায় ভুয়া নিয়োগ ও জাল-জালিয়াতির নথিপত্র তৈরি করে শিক্ষক-কর্মচারীদের অনলাইনে এমপিওভুক্তির আবেদন দাখিলের ঘটনা একের পর এক প্রকাশ্যে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত নভেম্বর মাসে সাদুল্লাপুর, সুন্দরগঞ্জ ও পলাশবাড়ী উপজেলার সাতটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১১ জন ভুয়া নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীর এমপিও আবেদনে ভয়াবহ অনিয়ম ও জাল নথির তথ্য-প্রমাণ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও কথিত নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা দায়িত্বপ্রাপ্ত মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এবিএম নকিবুল হাসানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ও ‘ম্যানেজ’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসব এমপিও আবেদন দাখিল করেন। অভিযোগকারীদের দাবি, প্রতিটি আবেদন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে অগ্রায়নের বিনিময়ে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে।
একাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর অভিযোগ, শিক্ষা অফিসার নকিবুল হাসান দীর্ঘদিন ধরে পলাশবাড়ী উপজেলায় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সাদুল্লাপুর ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন। তিন উপজেলার দায়িত্বে থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি এমপিও আবেদন প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও ঘুষ-বাণিজ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
ভুয়া নিয়োগ ও জাল নথিভিত্তিক এমপিও আবেদনের বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে নড়েচড়ে বসেন জেলা শিক্ষা অফিসার মো. আতাউর রহমান। তবে তিনি নিজেই একাধিক ভুয়া ও জাল এমপিও আবেদন ফাইল বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অগ্রায়নের বিষয়টি স্বীকার করেন। যদিও পরে কয়েকটি আবেদন বাতিল করা এবং কিছু ফাইল আলাদা করে রাখার দাবি করেন। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত শিক্ষা অফিসার এবিএম নকিবুল হাসানকে ব্যাখ্যা তলব করে নোটিশ দেন জেলা শিক্ষা অফিসার আতাউর রহমান। নোটিশে তাকে গত ২১ ডিসেম্বর সশরীরে হাজির হয়ে লিখিত জবাব দিতে বলা হয়।
এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার মো. আতাউর রহমান বলেন, ‘নকিবুল যেসব জাল-জালিয়াতিপূর্ণ এমপিও আবেদন ফাইল অগ্রায়ন করেছে, সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। তার লিখিত জবাব পাওয়া গেছে। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের কাছেও শিক্ষকদের অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি জানানো হয়েছে।’
তবে অধীনস্ত কর্মকর্তা নকিবুল হাসানের সঙ্গে ঘুষ গ্রহণ ও অর্থ ভাগাভাগিতে জেলা শিক্ষা অফিসারের কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না—এই প্রশ্ন শিক্ষক সমাজে তীব্রভাবে উঠেছে। একাধিক ভুয়া ও সৃজনকৃত কাগজপত্রের আবেদন অগ্রায়নের ঘটনায় জেলা শিক্ষা অফিসারকেও ঘিরে শিক্ষকরা ক্ষোভ ও সন্দেহ প্রকাশ করছেন।
একাধিক অভিযোগ ও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছয়জন, সাদুল্লাপুর উপজেলার দুটি বিদ্যালয়ের তিনজন এবং পলাশবাড়ী উপজেলার দুটি বিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষক-কর্মচারীর এমপিও আবেদন ভুয়া নিয়োগ ও জাল নথির ভিত্তিতে দাখিল করা হয়েছে। এসব আবেদনে নিয়োগ প্রক্রিয়া, সিএস কপি ও সংশ্লিষ্ট নথিতে গুরুতর অসংগতি ও জালিয়াতির বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এর মধ্যে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শান্তিরাম বাগানচালী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অফিস সহায়ক রাশেদা খাতুন ও নৈশপ্রহরী আল আমিন মিয়ার এমপিও আবেদন আগেই বাতিল হলেও পরবর্তীতে তা পুনরায় অগ্রায়ন করা হয়। একইভাবে শোভাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (কৃষি) গোলেনুর জাহান আকতার বানু এবং আব্দুল কাদের মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের জয়নাল আবেদীন (শারীরিক শিক্ষা) ও আখতারুজ্জামান রাজু (সামাজিক বিজ্ঞান)—এই তিনজনের নিয়োগসংক্রান্ত সব কাগজপত্র অনুসন্ধানে সম্পূর্ণ জাল ও সৃজনকৃত বলে উঠে এসেছে।
এর আগে সাদুল্লাপুর উপজেলার হিংগারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড বিএম কলেজের কথিত সহকারী শিক্ষক (আইসিটি) মোজাম্মেল হকের এমপিও আবেদন নিয়েও ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তিনি ২০০৪ সালে নিয়োগের দাবি করে ২০২৪ সালের ১১ জানুয়ারি এমপিও আবেদন করেন। অথচ যাচাই কমিটি জানায়, সংযুক্ত সিএস কপিতে শিক্ষা অফিসারের স্বাক্ষর নেই। এছাড়া ২০২৪ সালের ২৮ মার্চে জেলা কমিটির যাচাই-বাছাইয়েও তার নিয়োগ ভুয়া ও জাল বলে প্রমাণ হয়েছিল।
একইভাবে মাদারহাট আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাদেকুল ইসলাম ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (আয়া) খালেদা খাতুনের এমপিও আবেদনও দাখিল করা হয়, যদিও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে নিয়োগ পরীক্ষা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব নথি শতভাগ ভুয়া ও কৃত্রিমভাবে তৈরি। অভিযোগ রয়েছে, ওই বিদ্যালয়ের এক সুচতুর প্রধান শিক্ষক হায়দার আলী ৪ লাখ টাকা ঘুষ চুক্তিতে এমপিওভুক্তির সুপারিশ করে গত ২৮ সেপ্টেম্বর তাদের আবেদন দাখিল করান।
এর আগে নকিবুল হাসানের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে গত ১০ ডিসেম্বর ছয়জন শিক্ষক-কর্মচারী গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগকারীদের দাবি, অভিযোগ দেওয়ার পরও কার্যকর কোনো তদন্ত শুরু হয়নি; বরং তারা নানাভাবে চাপ ও ভয়ভীতির মুখে রয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত শিক্ষা অফিসার এবিএম নকিবুল হাসান ফোনে ভুয়া নিয়োগ ও জালিয়াতিপূর্ণ এমপিও ফাইল অগ্রায়নের প্রশ্ন এড়িয়ে যান। এ সময় তিনি তার বিরুদ্ধে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ দেওয়া এবং তার পক্ষে ‘পজিটিভ’ সংবাদ প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে ফোন কেটে দেন।
নকিবুলের ঘুষ-বাণিজ্য ও ভুয়া নিয়োগে এমপিও ফাইল অগ্রায়নসহ নানা অভিযোগে জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অভিযোগকারী জানান, অভিযোগের পরও নকিবুল হাসান প্রভাব খাটিয়ে এমপিও আবেদন অগ্রায়নের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। অভিযোগ ও নিজের দুর্নীতির বিষয় ধামাচাপা দিতে তদবির, দৌড়ঝাঁপ, সংবাদকর্মী ‘ম্যানেজ’ এবং অভিযোগকারীদের হুমকির অভিযোগও উঠেছে। অভিযোগকারীদের একজন সহকারী প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর কবিরকে ফোনে হুমকি দেওয়ার ঘটনাও সামনে এসেছে।
অভিযোগ রয়েছে, নকিবুলের চাকরির মেয়াদ দেড়-দুই বছর বাকি থাকায় তিন উপজেলায় অফিস না করে জেলা শহরে বাসায় বসেই ‘অফিস’ পরিচালনা করছেন তিনি। এ কারণে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে নিজের আখের গোছাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ।
আরও পড়ুন
বড়লেখায় দুর্বৃত্তের হামলায় দুই ভাই নিহত, আহত ১
এদিকে, জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। তবে শিক্ষক সমাজ দ্রুত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও দৃশ্যমান তদন্ত শেষে দুর্নীতিবাজ নকিবুলের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় বিভাগীয় এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছে।

