০২ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০:০৩:৪৪ অপরাহ্ন
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রায় বাস্তবতার ছাপ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০৫-২০২৪
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রায় বাস্তবতার ছাপ

অর্জনের শঙ্কা থেকেই শেষ পর্যন্ত এক শতাংশ কমিয়ে চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় উচ্চাভিলাষী থেকে বেরিয়ে আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও ৭ শতাংশের নিচেই রাখা হচ্ছে। সর্বশেষ দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ সংক্রান্ত ‘আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার’ সংক্রান্ত কো-অডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে আগামী তিন অর্থবছরের (২০২৪-২৫ থেকে ২০২৬-২৭) গড় প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘরে থাকবে এমন প্রাক্কলন করা হয়েছে। অর্থ বিভাগ বলেছে-মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে প্রবৃদ্ধিতে এ শ্লথগতি দেখা দিয়েছে। তবে মধ্য মেয়াদে এর গতিশীলতা বাড়বে।


তবে অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা-প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অপেক্ষাকৃত বাস্তব ও গ্রহণযোগ্য হলেও অর্জন করা কঠিন হবে। কারণ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির নিয়ামক হচ্ছে বিনিয়োগ। নানা সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে বিনিয়োগ হচ্ছে না। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। যা টাকার অঙ্কে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। এর বড় একটি অংশ আসে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই থেকে। কিন্তু এফডিআই বাড়াতে সরকারের নানা পদক্ষেপের পরও কমছে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ। জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিট বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ ছিল ৩২৪ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার। অথচ আগের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে এই অঙ্ক ছিল ৩৪৩ কোটি ৯৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার। হিসাব বলছে, বছর ব্যবধানে বিনিয়োগ কমেছে ৫.৫২ শতাংশ। মূলত ডলার সংকট, অর্থ পাচার ও দুর্নীতি, অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা, সেবা প্রাপ্তিতে ভোগান্তি ও জ্বালানি সংকটের মতো বিষয়গুলোকে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার মূল কারণ হিসাবে মনে করা হচ্ছে।


এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, বিশ্বের অনেক দেশে সুদহার বেড়েছে। সঙ্গত কারণেই সেসব দেশে মূলধনের বড় অংশ বিনিয়োগ হচ্ছে। আমাদের এখানে কেউ বিনিয়োগ করতে হলে তাকে দুইটা ফ্যাক্টর কনসিডার করতে হয়। তার একটা হলো মুদ্রা বিনিময় হার ঝুঁকি, আরেকটা বিনিয়োগের ঝুঁকি। যে কারণে উন্নত দেশের যেখানে মুদ্রা বিনিময় হারে কোনো ঝুঁকি নেই, সেখানে এই মূলধন চলে যায়।


উল্লেখিত কারণ ছাড়াও বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এছাড়া আগের বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক থাকবে বলে অর্থ বিভাগ মনে করছে। এগুলোর প্রভাব এসে পড়েছে প্রবৃদ্ধিতে। যে কারণে চলতি অর্থবছরের শেষ সময়ে এসে জিডিপির আকার সংশোধন করে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। টাকার অঙ্কে ৫০ লাখ ২৪ হাজার ৮১৭ কোটি নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও বিশ্বব্যাংক আরও কমিয়ে বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে।


এদিকে সরকারের ‘আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিয়ম হার সংক্রান্ত কো-অডিনেশন কাউন্সিল’ বৈঠকে আগামী তিন অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রার অনুমোদন দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ, টাকার অঙ্কে ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। এটি আগামী বাজেটে ঘোষণা দেওয়া হবে। এর বাইরে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ শতাংশ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরের ক্ষেত্রে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।


ওই বৈঠকে এই প্রবৃদ্ধি অর্জনের কয়েকটি যৌক্তিক কারণ তুলে ধরেছে অর্থ বিভাগ। সেখানে বলা হয়, সার্বিকভাবে চাহিদা কমে যাওয়া সত্ত্বেও বিশ্ব অর্থনীতি, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের উৎস দেশগুলোর স্থিতিশীলতা এবং খাদ্য উৎপাদনে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এছাড়া রপ্তানি, প্রবাস আয় ও আমদানি পরিস্থিতির উন্নতি এবং ফাস্টট্র্যাক প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরবরাহ বাড়িয়ে উন্নয়নের কারণে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে, মধ্যমেয়াদে তা ক্রমান্বয়ে বাড়বে।


জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, বহির্খাতের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। কাজেই এগুলো আমাদের অর্থনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নানা কারণে বাড়ছে না। ব্যাংক খাতের সমস্যার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমছে। বিদেশ থেকে কাঁচামাল, প্রাথমিক পণ্য ও মূলধনী যন্ত্রাংশ আমদানি বড় মাত্রায় কমছে। এতে বিনিয়োগ কমার বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। ফলে চলতি অর্থবছরে সংশোধন করে যে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, তা অপেক্ষাকৃত বাস্তবসম্মত। আগামী অর্থবছরেও খসড়া প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেটিও অনেকটা উচ্চাভিলাষী বলে আমি মনে করি। কারণ বর্তমান ডলার সংকট, রপ্তানি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে নতুন লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণযোগ্য হলেও কিন্তু অর্জন হবে না।


প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থ বিভাগের এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ২০২২-২৩ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ১ শতাংশ, ২০২৩-২৪ সালে ৩ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ সালে ৩ দশমিক ২ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়। মূলত ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। তা মোকাবিলায় বিশ্বের প্রায় দেশই নীতি সুদহার বাড়াতে থাকলে প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যায়। তবে ইতোমধ্যে অনেক দেশের মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। ফলে মধ্যমেয়াদে প্রবৃদ্ধির গতিধারা স্থিতিশীল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি মধ্যমেয়াদে ৪ শতাংশের ওপরে থাকবে। পাশাপাশি এশিয়ার উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হার ৫ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে।


ওই বৈঠকে অর্থসচিব মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার জানান, সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে করোনা অতিমারিকালে দক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসছে বাংলাদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ হলেও মধ্যমেয়াদে এর গতি ক্রমান্বয়ে বাড়বে। এছাড়া চলতি অর্থবছরে আমন ও বোরো ধানের উৎপাদন ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকবে। এতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে।


শেয়ার করুন