০৫ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার, ১২:৫৯:১৫ পূর্বাহ্ন
দাগি আসামিদের বিক্রি করা হয় নিলামে তুলে
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-০৫-২০২৪
দাগি আসামিদের বিক্রি করা হয় নিলামে তুলে

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে টাকা দিলে সবই মেলে। টাকার বিনিময়ে উন্নত জীবনযাপনের সব সুবিধা রয়েছে এখানে। কারাগারের ভেতরে মোবাইল ফোনে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার, বন্দি কেনাবেচা, ভালো খাবার কিংবা মাদক মেলে হাতের নাগালে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের থাকার জন্য ছয়টি পাঁচতলা ভবন রয়েছে।


এসব ভবনে দাগি আসামিদের জন্য ১২০টি ওয়ার্ড আছে। অভিযোগ উঠেছে, সব ওয়ার্ডের দাগি অপরাধীদের নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়। বড় অপরাধের আসামিরা কারাগারে গেলে তাদের অপরাধের ধরন, আর্থিক অবস্থা জেনে বিভিন্ন ওয়ার্ডের মেটরা তাদেরকে চিফ রাইটারের কাছ থেকে প্রতিযোগিতামূলক দামে কিনে নেয়। তারপর তাদের ওয়ার্ডে রেখে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বাণিজ্য করে নেয়। কারাগারে বন্দিদের খাবার সঠিকভাবে বণ্টন করা হয় না-এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বন্দিদের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত খাবারের একটি বড় অংশ আত্মসাৎ করে মাসে ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কারাগারের দায়িত্বে থাকা একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এর ফলে নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার পান না সাধারণ কয়েদিরা। অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের জন্য দৈনিক ৮৫ বস্তা চাল বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু ৫৫ থেকে ৬০ বস্তা চাল রান্না হয়। বাকি চাল বিক্রি করে দেয় ওই সিন্ডিকেট।


এছাড়া বন্দি বেচাকেনা, সাক্ষাৎ বাণিজ্য, প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা, ওয়ার্ডের সিট বাণিজ্য, খাবার বাণিজ্য, জামিন বাণিজ্য এবং ভিআইপি বন্দিদের উন্নত জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কারাগারের ভেতরের চক্রটি।


অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে যত অনিয়ম-দুর্নীতি হয়, এর অন্যতম নেপথ্যে রয়েছেন এ কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ মনজুর হোসেন ও ডেপুটি জেলার সুমাইয়া খাতুন। এ দুই কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় কারারক্ষী থেকে কর্মকর্তা-সবাই যেন টাকার কুমির বনে গেছেন। নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করতে গিয়ে কারাগারে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য খুঁজে পায় সংশ্লিষ্ট কমিটি।


সদ্য জামিনে মুক্তি পাওয়া আসামিরা জানান, বিচারাধীন কিংবা সাজাপ্রাপ্ত কোনো নতুন কয়েদি কারাগারে গেলে প্রথমে তাকে রাখা হয় ‘আমদানি’ ওয়ার্ডে। সেখান থেকেই জেনে নেওয়া হয় তার কী কী প্রয়োজন। সে অনুযায়ী প্রথম রাতেই হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় কারাগারে নগদ অর্থের বিনিময়ে কী কী সুবিধা পাওয়া যায়-এমন একটি তালিকা। কারাগারের ভেতরে সিমকার্ড পেতে গেলে এক রকম ‘চার্জ’, মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে চাইলে আলাদা চার্জ। বাইরে কথা বলতে গেলে প্রতি মিনিটের হিসাবে আবার গুনতে হয় বাড়তি টাকা।


টাকার বিনিময়ে সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় এ কারাগারে। আসামিদের কাছ থেকে চাহিদামতো টাকা পেলে মোবাইল ফোনে বাইরের সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখার সুযোগ করে দেন তারা। শুধু তাই নয়, কারাগারের ভেতরে চলে মাদকের রমরমা বাণিজ্য। ভেতরেই মেলে গাঁজা, মদ, ইয়াবা, আইসসহ ভয়ংকর সব মাদক। বিভিন্ন সময়ে কারাগারের ভেতরে বন্দিদের কাছে মাদক উদ্ধার করলেও কেস টেবিলে জেল সুপার বিচার করেন না। নগদ টাকা দিলে তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।


অভিযোগ আছে, ডেপুটি জেলার ও জেল সুপারের ব্যক্তিগত লোক দ্বারা দীর্ঘদিন কারাগারের ভেতরে বিশেষ শাখায় পোস্টিং বাণিজ্য চলছে। কারারক্ষী কাউছার দুই বছর ধরে কারাগারের সব ক্যান্টিনের বাজারের দায়িত্বে রয়েছেন। বাজারের সঙ্গে ভেতরে অনায়াসে টাকার বিনিময়ে মাদক ও মোবাইল ফোন সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কারারক্ষী (নম্বর ২৬৪৯) সোহেল সব সময় কারাগারের ভেতরে আসা-যাওয়া করতে পারেন। সেই সুবাদে তিনি আসামিদের কাছে মাদক, মোবাইল ফোন সরবরাহসহ এমন কোনো কাজ নেই যা করেন না। কারণ, তিনি কারাগারের ভেতরে ঢোকার সময় গেটে কোনো তল্লাশি করা হয় না। কারারক্ষী (নং ২৮৬৯) রাসেল ক্যান্টিনের দায়িত্বে থাকার কারণে গুদামের হিসাব নয়ছয় করে মোটা অঙ্কের টাকা আয় করে মাস শেষে জেল সুপারকে সব টাকা বুঝিয়ে দেন। জেল সুপার রাসেলকে প্রতিমাসে এক লাখ টাকা ‘সম্মানি’ হিসাবে দেন।


নিয়ম আছে, হাজতি বন্দি ৭ দিন পরপর তাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। কিন্তু চট্টগ্রাম কারাগারে টাকার বিনিময়ে যখন-তখন সাক্ষাৎ করা যায়। কারাগারের বিভিন্ন বিভাগে জেল সুপার অতিরিক্ত লোক নিয়োগ করে রেখেছেন। জানা যায়, হাজতি-কয়েদি শাখায় ১৬ জন কারারক্ষী কাজ করেন। বিগত দিনে ওই জায়গায় ৫ জন কারারক্ষী কাজ পরিচালনা করতেন। ডাক বিভাগে ৩ জন কারারক্ষী, বিগত দিনে ১ জন ছিলেন। বর্তমানে সংস্থাপন শাখায় ৪ জন কারারক্ষী কাজ করেন। বিগত দিনে ২ জন ছিলেন। অনেককে শুধু অফিসে পোস্টিং দিয়ে রাখা হয়েছে যাতে রাতে ডিউটি করতে না হয়। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করেন কারারক্ষী মনির (২০৭৮), সাইফুল (২৫৮৬), হাবিব (২৬৪৪) ও সাইফুল (৩২০১)। তারা সব পোস্টিং কেনাবেচা করেন।


কারাগারে আয়েশি জীবন : কেডিএস খলিলের ছেলে ইয়াছিন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তিনি টাকার বিনিময়ে কারাগারে রাজকীয় জীবনযাপন করে যাচ্ছেন। শুধু ডিভিশন নয়, তার রুমে রয়েছে দুটি ফ্রিজ, দুটি মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ। পরিবারের লোক ও বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা করার জন্য কনফারেন্স রুম হিসাবে ব্যবহার করেন জেল সুপারের ব্যক্তিগত কক্ষ। তার নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী ও খাবার বাইরের কারারক্ষী এমদাদ কারা ফটক পর্যন্ত নিয়ে যান। পরে গেট সার্জেন্টের মাধ্যমে বিনা বাধায় ইয়াছিনের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।


নিরাপত্তা সেলে দেখাসাক্ষাতের দায়িত্বে থাকা পিআইও সদস্য ইউছুপ ও মোশাররফ সাক্ষাৎ প্রার্থীদের কাছ থেকে ২-৩ হাজার টাকার বিনিময়ে আসামিদের নিরাপদে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেন। বন্দিদের মাঝে মাদক সরবরাহের অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। যমুনা ১৭-১৮নং ওয়ার্ডে সব সময় মাদক মজুত করে রাখা হয়। সেখান থেকে কারাগারের কয়েদি নুর আলম এসব মাদক বিক্রি করেন। এসব মাদক পিআইও সদস্য ইউছুপ ও মোশাররফের সহায়তায় কারাগারের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে সদ্য মুক্তি পাওয়া কয়েকজন আসামি জানিয়েছেন।


এ ব্যাপারে জানতে সিনিয়র জেল সুপার মনজুর হোসাইনের সরকারি এবং তার ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি কল না ধরায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে তার সঙ্গে অফিসে দেখা করার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।


চট্টগ্রাম বিভাগীয় কারা উপমহাপরিদর্শক টিপু সুলতানের কাছে এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বক্তব্য দেওয়া সম্ভব হবে না।


শেয়ার করুন