২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৮:১৪:৪০ অপরাহ্ন
সেই দুর্যোগের দিন ঘিরে নতুন শঙ্কা
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-০৫-২০২৪
সেই দুর্যোগের দিন ঘিরে নতুন শঙ্কা

আজ ২৫ মে। ২০০৯ সালের এই দিনে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে তছনছ হয়ে গিয়েছিল সুন্দরবন ঘেঁষা সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চল। ওই দুর্যোগের ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো শ্যামনগরের গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নের অর্ধলক্ষাধিক মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। 


ঘর নির্মাণ করতে না পারায় এখনো বেড়িবাঁধের ওপর খুপরি ঘরে বসবাস করছেন অনেকেই। মেগা প্রকল্পে একটি বেড়িবাঁধ হলেও অন্য বাঁধের অবস্থা ভঙ্গুর। এলাকায় সুপেয় পানির অভাব তীব্র। স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়েছে অনেক আগেই। এর মধ্যে একই সময়কালে আরেক ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’ আতঙ্কে উপকূলবাসী।


আশাশুনির কুড়িকাউনিয়া গ্রামের বাসিন্দা রাজীব আহমেদ বলেন, ‘কুড়িকাউনিয়া ও সুভদ্রাকাটি এলাকায় কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আইলার আঘাতে লন্ডভন্ড হওয়ার পর বেড়িবাঁধ সেই অর্থে টেকসই করে নির্মাণ করা হয়নি। ঘূর্ণিঝড় রিমাল যদি আঘাত হানে, তবে আমরা আবারও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ব।’ 


খোলপেটুয়া নদীর পারে বসবাসকারী বন্যতলা এলাকার শামসুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমাল যদি আঘাত হানে, অথবা রিমালের প্রভাবে যদি ৫-৬ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়, তবে এই এলাকার কয়েক হাজার হেক্টর জমির চিংড়িঘের তলিয়ে যাবে। 


রিমালের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দীন বলেন, ৪০ হাজার জিও ব্যাগ বালু মজুত রয়েছে। রিমালের প্রভাবে নদীর বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তৎক্ষণাৎ জিও ব্যাগ ফেলার প্রস্তুতি রয়েছে। 


জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির বলেন, রিমাল আঘাত হানতে পারে ধরে নিয়ে ১৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্রসহ ৮৮৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রস্তুত করা হচ্ছে। ৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছে। এ ছাড়া তাৎক্ষণিক ব্যয়ের জন্য ৫ লক্ষাধিক টাকা রয়েছে। 


এলাকাবাসী ও চাষিরা জানান, আইলার আঘাতের পর থেকে গোটা এলাকা উদ্ভিদশূন্য হয়ে পড়েছে। লবণাক্ততার কারণে কমপক্ষে ২০ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে। কর্মহীন মানুষ এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে বাইরে চলে যাচ্ছেন। 

এ প্রসঙ্গে পদ্মপুকুর গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, তাঁরা তিন ভাই। কাজের সন্ধানে তাঁর দুই ভাই ইতিমধ্যে এলাকা ছেড়েছেন। তিনিও অন্যত্র যাওয়ার কথা ভাবছেন। 


সরেজমিনে দেখা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধগুলো ঝুঁকির মধ্যে। গাবুরা ইউনিয়নের খলসেবুনিয়া এলাকায় ক্লোজার বেড়িবাঁধের ওপর বসবাসকারী শতাধিক মানুষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। অর্থাভাবে তাঁরা পিতৃভিটায় গিয়ে ঘর তৈরি করতে পারছেন না। এদিকে পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বন্যতলা, প্রতাপনগর ইউনিয়নের রুইয়ার বিলসহ পাঁচটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভাঙা। এ ছাড়া বুড়িগোয়ালিনী, হরিনগরসহ প্রায় ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ হুমকির মুখে। তবে গাবুরার জেলেখালী এলাকায় ১ হাজার ২০ কোটি টাকায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। 


এ বিষয়ে জেলেখালী গ্রামের নৃপেন রায় বলেন, কাজের কাজ এইটুকুই হচ্ছে। আইলার পরে শুধু এই কাজটুকু ছাড়া আর কোনো উন্নয়নের চিত্র চোখে পড়ে না। তবে কামালকাটি গ্রামের জিএম আবুল হোসেন বলেন, বেড়িবাঁধ ভাঙতে ভাঙতে তাঁদের বাড়ি গ্রাস করার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে তাঁরা এখন কোথায় যাবেন, এই চিন্তায় আছেন।


সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দীন বলেন, জেলায় প্রায় ৭০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। দেবহাটা, আশাশুনির প্রতাপনগর, শ্যামনগরের হরিনগর, কামালকাটিসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় ঝুঁকি রয়েছে। 


এদিকে গাবুরা ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের মধ্যে ১৩টি গ্রামের মানুষের খাওয়ার পানির একমাত্র উৎস ‘পুকুর’। অনেক নারী দুই-তিন কিলোমিটার হেঁটে এক কলস পানি আনেন। নোংরা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ এসব পানি পান করে রোগাক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। কিছুটা সচ্ছল লোকেরা ৩০ টাকা দরে পানির ড্রাম পাশের উপজেলা কয়রা থেকে কিনে আনছেন। 


গাবুরার চাঁদনীচক এলাকার বাসিন্দা আলেয়া খাতুন বলেন, খাওয়ার পানির অনেক সংকট। তিন কিলোমিটার হেঁটে পানি আনতে আনতে এক বেলা পার হয়ে যায়। সংসারের অন্য কাজ করার সময় কই। এ বিষয়ে সাতক্ষীরার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম বলেন, উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। সমস্যা সমাধানে সোলার সিস্টেম ওয়াটার প্লান্ট চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইউনিসেফের কয়েকটি প্রকল্প চালু হলে সংকটের সমাধান অনেকাংশে সমাধান হবে। 


সার্বিক বিষয়ে জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির বলেন, ২৫ মে আইলায় সাতক্ষীরা উপকূলের মানুষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পর থেকে টেকসই বেড়িবাঁধসহ মানুষের কল্যাণে কিছু কাজ হয়েছে। তবে এ কথা সত্য, আইলার পরে কিন্তু অন্য ঘূর্ণিঝড়ে প্রস্তুতি থাকায় সাতক্ষীরার মানুষ এত ক্ষতিগ্রস্ত হননি। আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ, যাঁরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি, তাঁদেরকে আরও বেশি সামাজিক বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে আসার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তাঁদের নিরাপদ বসবাসের জন্য সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 


প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ২৫ মে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসসহ ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ আঘাত হানে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদে। মুহূর্তের মধ্যে সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে যায়। স্বাভাবিকের চেয়ে ১৪-১৫ ফুট উচ্চতায় সমুদ্রের পানি এসে নিমিষেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় নারী ও শিশুসহ পাঁচ শতাধিক মানুষ, হাজার হাজার গবাদিপশু আর ঘরবাড়ি। গৃহহীন হয়ে পড়ে লাখো পরিবার। কয়েক লাখ হেক্টর ঘেরে চিংড়ি আর ফসলের খেত তলিয়ে যায়। ধ্বংস হয়ে যায় উপকূল রক্ষা বাঁধ আর অসংখ্য ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শুধু সাতক্ষীরায় মারা যায় ৭৩ নারী-পুরুষ-শিশু। আহত হয় সহস্রাধিক মানুষ।


শেয়ার করুন