অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখীসহ চাপে থাকা সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্যেই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট চূড়ান্ত করেছে সরকার।
এটি চলতি (২০২৩-২৪) সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। এবার ব্যয় বাড়ছে ৮২ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। বড় অঙ্কের ব্যয় মেটাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৪ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এটি অর্জন করতে চলতি সংশোধিত রাজস্ব থেকে ৬৬ হাজার কোটি টাকা বেশি আহরণ করতে হবে, যা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যান্য বছরের মতো জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রেখেই ঘাটতি (অনুদানসহ) রাখা হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির অঙ্ক হচ্ছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।
বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম এ বাজেট বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। অর্থমন্ত্রী হিসাবে এটি তার প্রথম বাজেট। এবার বাজেটের প্রতিপাদ্য হচ্ছে-‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার’।
ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ থাকছে আগামী বাজেটে। মোট বাজেটের ২০ শতাংশই চলে যাবে সুদ পরিশোধে। টাকার অঙ্কে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে সুদ খাতের ব্যয় বাজেটে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। এর মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৯৩ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদে ব্যয় হবে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
আর্থিক সংকট মোকাবিলায় গত কয়েক বছর ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকার কৃচ্ছ্রসাধন করে আসছে। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করা হচ্ছে। এর একটি নমুনা হচ্ছে ভূমি অধিগ্রহণ, সম্পদ সংগ্রহ, নির্মাণ ও পূর্ত কাজ এবং শেয়ার ও ইক্যুইটিতে বিনিয়োগের জন্য বরাদ্দ থাকছে ৩৭ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে আছে ১৯ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। এছাড়া আগামী বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি সংশোধিত এডিপির লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে সরকারের দায়দেনা অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে অবস্থান করছে। ক্রমবর্ধমান দায়দেনা পরিস্থিতি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে চোখ রাঙাচ্ছে। শুধু বিদেশি ঋণ নয়, দেশের অভ্যন্তর থেকে নেওয়া ঋণও সরকারের দায়দেনা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আসন্ন বাজেটে অর্থের জোগান দিতে সরকারকে আগের চেয়ে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৫ শতাংশের সমান। চলতি অর্থবছরে ঋণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ২ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে দাতা সংস্থাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা (১০৮৭ কোটি মার্কিন ডলার)। তবে আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধে ব্যয় হবে ২৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাকি ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা থাকবে নিট বৈদেশিক ঋণ হিসাবে।
অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে ডলার সংকট বিদ্যমান। যে কারণে চলতি অর্থবছরের চেয়ে বেশি মাত্রায় বিদেশি ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৭৬ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না, তাই দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর সরকারকে বেশি ভরসা করতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই ঋণের ভার আরও বাড়বে। বিদেশি ঋণে প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে এখন থেকে আরও সতর্ক থাকা উচিত। এসব ঋণের শর্ত, মেয়াদ, সুদের হার-এসব বিশ্লেষণ করতে হবে।’
সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরেই অভ্যন্তরীণ ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ যত অর্থ রাখা হয়েছিল, ১০ মাসেই সেই বরাদ্দ শেষ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়া হচ্ছে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। যার মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে আসবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
এছাড়া সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি এবং অন্যান্য খাত থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হবে। তবে আইএমএফ-এর শর্ত পালন করতে গিয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে পর্যায়ক্রমে ঋণ নেওয়ার অঙ্ক কমিয়ে আনছে অর্থ বিভাগ। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না নিয়ে উলটো ৭ হাজার ৩১০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়।
এদিকে বিদেশি ঋণ, সুদ ও ভর্তুকির মতো ব্যয় মেটাতে রাজস্ব খাতের চাপ কাটছে না এমনিতে। ব্যয় আরও বৃদ্ধির কারণে চাপ আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত থাকছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগামী অর্থবছরে বড় ধরনের কর নেটের আওতা বাড়ানো হচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর আদায় করবে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খাদ্য সহায়তা হিসাবে অনুদান মিলবে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
বাকিটা আদায় করতে হবে এনবিআরকে। দেখা গেছে, শুধু এনবিআর নিয়ন্ত্রী কর আদায় করা হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা সাধারণ মানুষের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। এনবিআর-বহির্ভূত কর আদায় হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কর ব্যতীত প্রাপ্তি ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
এ বড় অঙ্কের কর আদায়ে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ১০ লাখ বা এর বেশি মূসক (ভ্যাট) পরিশোধের ক্ষেত্রে ই-পেমেন্ট বা এ-চালান বাধ্যতামূলক হবে। বর্তমান ই-পেমেন্ট বা এ-চালান শুধু ৫০ লাখ টাকা বা তার বেশি ভ্যাট পরিশোধে ব্যবহারের বিধান আছে। সেটি কমিয়ে আনলে এ খাত থেকে অনিময় দূর হবে এবং রাজস্ব আহরণ বাড়বে।
এছাড়া ইলেকট্রনিকস টেক্স ডিক্টেশন সোর্স (ইটিডিএস) অনলাইন প্ল্যাটফরম চালু, রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি, সেবার মান উন্নয়ন ও রাজস্ব আদায় বাড়াতে আয়কর আইন-২০২৩ প্রয়োগ করা হবে।
পাশাপাশি ঢাকা ও চটগ্রাম শহরে অনেক আয়করদাতা রয়েছেন; কিন্তু তারা কর দিচ্ছেন না। তাদের করজালের আওতায় আনতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইডিএফ মেশিন স্থাপনের জন্য একটি বেসরাকরি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। খুব শিগ্গিরই বহু প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনা হবে। এছাড়া নতুন করদাতাদের কর জালে আনতে বিআরটিএ, সিটি করপোরেশন, ডিপিডিসির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
জানতে চাইলে সাবেক অর্থসচিব (সিনিয়র) মাহবুব আহমেদ শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, আগামী অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হবে। ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি না বাড়লে রাজস্ব আয়ও বাড়বে না। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দৃশ্যমান কোনো সংস্কার দেখা যাচ্ছে না। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে প্রযুক্তিগত, প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। বিশেষ করে কাগজবিহীন ও স্বচ্ছ কর পদ্ধতি চালু করা দরকার।