কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের প্রায় ২০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক শরণার্থীর শরীরে সক্রিয় হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) পরিচালিত এক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে। গত বছরের (২০২৩) মে এবং জুনের মধ্যে কক্সবাজারের সাতটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৬৮০টি পরিবারের মধ্যে সমীক্ষা করা হয়। সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে হেপাটাইটিস সংক্রমণের সংস্পর্শে এসেছিল। এর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশের মধ্যে সক্রিয় ‘হেপাটাইটিস সি’ সংক্রমণ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা যুগান্তরকে বলছেন, সীমিত পরিসরে চালানো এই সমীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে পুরো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের তুলনা করলে বোঝা যায় যে, প্রায় পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন বর্তমানে এইচসিভি সংক্রমণের সঙ্গে বসবাস করছেন। সংখ্যার দিক থেকে শরণার্থীদের মধ্যে আনুমানিক ৮৬ হাজার ৫০০ মানুষ ‘হেপাটাইটিস সি’ ভাইরাস সংক্রমণে ভুগছেন।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্তবাহিত ভাইরাস ‘হেপাটাইটিস সি’ এমন একটি রোগ যা সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের জন্য কোনো লক্ষণ প্রকাশ ছাড়া নীরব থাকতে পারে। যদি চিকিৎসা না করা হয়, এটি লিভারকে আক্রমণ করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন-সিরোসিস বা লিভার ক্যানসার, ডায়াবেটিস, হতাশা এবং ক্লান্তি তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশে কর্মরত এমএসএফের মিশনপ্রধান সোফি বেলাক বলেন, বিশ্বের নিপীড়িত জাতিগত সংখ্যালঘু হিসাবে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কয়েক দশক ধরে নিজ দেশে স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপদ চিকিৎসা সংকটের মূল্য দিতে হচ্ছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জাম ইনজেকশন সিরিঞ্জসহ বিভিন্ন চিকিৎসা যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না করেই শরণার্থী সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। যা অতিরিক্ত জনবহুল শিবিরে বসবাসকারী জনসংখ্যার মধ্যে হেপাটাইটিস সি’র উচ্চ প্রাদুর্ভাবের বড় কারণ। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ক্যাম্পগুলোতে বসবাসকারীদের রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার সুযোগ খুবই সীমিত। সেখানে হেপাটাইটিস সি আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। কিন্তু বেশির ভাগ শরণার্থীকে এ রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে নিরাময় করা যাচ্ছে না। কয়েক বছর ধরে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে ‘হেপাটাইটিস সি’ আক্রান্ত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর চিকিৎসা নিতে আসার হার দেখে চিকিৎসা উপকেন্দ্র, এমএসএফের এপিডেমিওলজি (রোগতত্ত্ব বিভাগ) এবং রিসার্চ সেন্টার সমীক্ষা পরিচালনার এই কর্মসূচি গ্রহণ করে। সমীক্ষা পরিচালনা সংশ্লিষ্টরা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, কক্সবাজারে জনবহুল শরণার্থী শিবিরে এমএসএফ একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা চার বছর ধরে ‘হেপাটাইটিস সি’ আক্রান্তদের চিকিৎসা দিচ্ছে। তারপরও সামর্থ্যরে বাইরে থাকায় প্রতিদিনই স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র থেকে রোগীদের ফিরিয়ে দিতে হয়।
এমএসএফের ডেপুটি মেডিকেল কো-অর্ডিনেটর ডা. ওয়াসিম ফাইরুজ বলেন, এমএসএফ ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারে শরণার্থী ক্যাম্পে দুটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে (জামতলী ক্লিনিক এবং পাহাড়ের উদ্দি হাসপাতাল) বিনামূল্যে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস স্ক্রিনিং, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা দিচ্ছে। চলতি বছরের মে পর্যন্ত জিনএক্সপার্ট ডায়াগনস্টিক মেশিনের মাধ্যমে সন্দেহজনক সক্রিয় হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত ১২ হাজারেরও বেশি ব্যক্তির পরীক্ষা করা হয়েছে। নিশ্চিত সক্রিয় সংক্রমণে আক্রান্ত আট হাজারেরও বেশি রোগী এমএসএফ সুবিধাগুলোতে চিকিৎসা পেয়েছেন।
পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এবং সেভ দ্য চিলড্রেন ক্যাম্পের দুটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৯০০ জন হেপাটাইটিস সি রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।