০৭ জুলাই ২০২৪, রবিবার, ০৬:৪১:৫৩ অপরাহ্ন
যোগ্যদের অবমূল্যায়নে হতাশ মাঠের নেতারা
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-০৬-২০২৪
যোগ্যদের অবমূল্যায়নে হতাশ মাঠের নেতারা

বিএনপিতে আকস্মিক রদবদলে নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ঈদুল আজহার ঠিক দুইদিন আগে ৪৫ জন নেতাকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের পর ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছে দলটির একটি বড় অংশ। তাদের পর্যবেক্ষণ-রদবদলে আস্থাভাজনদের রাখতে গিয়ে বেশ কয়েকজন যোগ্য নেতাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। তাদের অনেক ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতা। এতে তৃণমূলে খারাপ বার্তা গেছে। আন্দোলনে মাঠে থাকা নেতারাও নিজেদের ভবিষ্যৎ অবস্থান নিয়ে টেনশনে পড়েছেন। যোগ্য ও নির্যাতিতরা অবমূল্যায়িত হলে আগামী দিনের আন্দোলনে প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে বলেও মনে করেন অনেক নেতা। তাদের মতে, এতে দলের চেয়েও শীর্ষ নেতৃত্ব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছেন না নেতারা।


এদিকে জাতীয় নির্বাহী কমিটির পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা-মহানগর কমিটি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের (মেয়াদোত্তীর্ণ) কমিটি ভেঙে নতুন নেতৃত্ব গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির শূন্য পদও পূরণ করা হবে। ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর অংশ হিসাবে বিলুপ্ত বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগর এবং কেন্দ্রীয় যুবদলের নতুন কমিটি যে কোনো সময় দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে খুলনা, কুমিল্লা, গাজীপুর, রাজশাহী মহানগরসহ অন্তত আরও সাতটি সাংগঠনিক জেলা কমিটি যে কোনো সময় ভেঙে দেওয়ারও আভাস পাওয়া গেছে। রাজধানী ঢাকার আশপাশের জেলা ও মহানগর কমিটি গঠন নিয়েও শিগ্গিরই বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একক ক্ষমতা প্রয়োগ করে কমিটি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। তবে পদায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক দক্ষতা, সামাজিক মর্যাদা বিবেচনা স্থান পাচ্ছে না। তুলনামূলক বিচারে পদ-পদবি অনুযায়ী যেভাবে নেতাদের মান নিচের দিকে নামিয়ে আনা হয়েছে, তাতে দলের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। নেতাকর্মীদের এ মনোভাব চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কান পর্যন্ত গেছে।


তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, ‘যোগ্যতার বিচারেই পদায়ন করা হচ্ছে।’


এদিকে স্থায়ী কমিটির সিনিয়র এই নেতার বক্তব্যের সঙ্গে অনেকেরই দ্বিমত রয়েছে। তারা বলেন, যুগ্ম মহাসচিব থেকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করা হয়েছে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মজিবুর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হারুন অর রশিদ ও আসলাম চৌধুরীকে। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দলীয় প্রধানকে পরামর্শ দেওয়া ছাড়া উপদেষ্টাদের সাংগঠনিক তেমন কোনো কাজ নেই। কিন্তু দলের দায়িত্বশীল পদ থেকে সরিয়ে উপদেষ্টা করায় তাদের অসম্মান করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। অথচ এসব নেতার দলে অনেক ত্যাগ রয়েছে। মাঠে থাকার কারণে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন, বহু মামলা রয়েছে। এমনকি কয়েকজনকে সাজাও দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে উপদেষ্টার চেয়ে ভাইস চেয়ারম্যান করা হলেও সম্মানজনক ছিল। তবে দায়িত্বশীল কারও পদ হারানো, কারও পদোন্নতি বা নতুন পদ পাওয়ার নেপথ্যে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির বিষয় ছিল বলে দলটির নেতাদের কেউ কেউ বলছেন।


সাবেক উপমন্ত্রী রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর স্থলে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহীন শওকত খালেককে (রাজশাহী বিভাগ) সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। রাজশাহীর একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, তারেক রহমান কথা দিয়েছিলেন যারা আন্দোলনে ভূমিকা রাখবে তাদের দলে মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু শাহীন শওকত কবে কোথায় আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে? কজন নেতাকর্মী তার সঙ্গে রয়েছে। আন্দোলনের সময় আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে রাজনীতি করার মতো আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন বলে ওই নেতা জানান। সহ-তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক খালেদ হোসেন চৌধুরী ফাহিনকে দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেওয়ায় দলের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে তিনি অপরিচিত মুখ। নেতাদের প্রশ্ন-তারেক রহমান তাকে কীভাবে চেনেন? দলের প্রচার সম্পাদক করা হয়েছে সদ্য বিলুপ্ত যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে এবং সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে বিএনপির সহ-প্রচারবিষয়ক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীমকে। দলের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা বলেন, ছাত্রদল ও যুবদলের নেতৃত্ব দেওয়া টুকুকে অতিমাত্রায় অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে ছাত্রদলের আরেক নেতা আলীমকেও। তবে এ দুই নেতা বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যখন যেখানে দায়িত্ব দেবেন, তা দলের স্বার্থে আমরা পালন করব। এখানে কোনো কিন্তু নেই।’


আবার সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদকে ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে আন্দোলনের সময় তার ভূমিকা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। এছাড়াও তিনি রাজনৈতিকভাবে আনকোরা। ছাত্র কিংবা যুবরাজনীতির অভিজ্ঞতা নেই। সাংগঠনিকভাবে দক্ষ কোনো নেতাও নন। এদিকে মেজর জেনারেল (অব.) মো. শরীফ উদ্দিনকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করা হয়েছে। তিনিও বিএনপিতে সক্রিয় নন। তার ভাই ছিলেন রাজশাহী-১ আসন থেকে তিনবার নির্বাচিত সংসদ-সদস্য এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত ব্যারিস্টার মো. আমিনুল হক। অনেকের ধারণা-ভবিষ্যতে রাজশাহী-১ আসন থেকে প্রার্থী করতেই শরীফ উদ্দিনকে বিএনপিতে পদ দেওয়া হয়েছে। আবার বেশ আগেই সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলনকে পদাবনতি করা হয়েছিল। তাকে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক থেকে সরিয়ে নির্বাহী সদস্য করা হয়। তবে এবারের রদবদলে মিলনের সহধর্মিণী নাজমুন নাহার বেবীকে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বিএনপির কেন্দ্রে তিনি প্রথমবারের মতো পদ পেলেন। মিলনকে পদাবনতি দিয়ে তার সহধর্মিণীকে কেন কেন্দ্রে পদ দেওয়া হয়েছে, এরও কারণ খুঁজছেন কেউ কেউ। আবার বিদেশে থাকা বেলায়েত হোসেন মৃধাকেও নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়েছে। তিনি ‘হাওয়া ভবনের’ লোক হিসাবে পরিচিত। কিন্তু বিএনপির রাজনীতিতে তার ভূমিকা কী, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের অনেকেই এ নিয়ে বিব্রত।


তবে নতুন রদবদলে যুগ্মমহাসচিব পদে আব্দুস সালাম আজাদ, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ও শহীদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানি এবং সাংগঠনিক সম্পাদক পদে কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল,শরিফুল আলম, জিকে গউছের মতো ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকে পদোন্নতি দেওয়ায় নেতাকর্মীরা খুশি হয়েছেন।


শেয়ার করুন