রাজশাহী আঞ্চলিক হাঁস-মুরগি, দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন এবং সরকারি ছাগল উন্নয়ন খামারে খাদ্য সরবরাহের ঠিকাদার নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে খামার তিনটির পশুখাদ্য সরবরাহ। খামারের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার যোগসাজশে হাতে গোনা দুই-তিনজন ঠিকাদার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছেন। ফলে ঘুরেফিরে তাঁরাই বারবার কার্যাদেশ পাচ্ছেন। এ বিষয়ে অভিযোগ পেয়ে তদন্তের উদ্যোগ নিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। সরকারি টাকা লোপাটে কর্মকর্তা-ঠিকাদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ করা হয়েছে। টেন্ডারে দুর্নীতির অভিযোগ এনে হাইকোর্টেও রিট করেছেন একজন সংক্ষুব্ধ ঠিকাদার। সর্বশেষ প্রায় অর্ধকোটি টাকার খাদ্য উপকরণ ও ওষুধ সরবরাহে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এ কাজটিও ওই সিন্ডিকেট হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়িতে অবস্থিত দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামারে খাদ্য উপকরণ সরবরাহে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। কয়েকজন ঠিকাদার কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে বারবার কাজ পাচ্ছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে খাদ্য উপকরণ সরবরাহের জন্য দরপত্র (টেন্ডার নম্বর ৬৮২৯৯৮) আহ্বান করা হয়।
টেন্ডারে জিআর-১ গ্রুপে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল রজব অ্যান্ড ব্রাদার্স। প্রতিষ্ঠানটি দর দেয় ৭৮ লাখ ৯৭ হাজার ৬৬০ টাকা। অপর দিকে একই কাজের জন্য মেসার্স করিম ট্রেডার্স দর দিয়েছিল ৮৬ লাখ ৪৯ হাজার ৪৫ টাকা। কিন্তু সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজটি দেওয়া হয়নি। বরং সাড়ে ৭ লাখ টাকা বেশি দরদাতা করিম ট্রেডার্সকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
জিআর-৩ টেন্ডার নম্বর ৮৫২১২২-এ খাদ্য উপকরণ হিসেবে ধানের খড়, ভুট্টা, ছোলা, ভিটামিন মিনারের প্রিমিক্স (ডিবি) এবং আয়োডিনযুক্ত লবণ সরবরাহে দরপত্র আহ্বান করা হয়। তাতে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল মেসার্স সদর অ্যান্ড ব্রাদার্স। প্রতিষ্ঠান দর দেয় ৩৯ লাখ ৭১ হাজার ৩৫৪ টাকা। অপর দিকে একই কাজের জন্য এইচএন এন্টারপ্রাইজ টেন্ডার মূল্য দেয় ৬৭ লাখ ৮৭ হাজার ৪৭৩ টাকা। সর্বনিম্ন দরদাতার চেয়ে ২৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা বেশি দর দিয়েও কাজটি পায় এইচএন এন্টারপ্রাইজ। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এইচএন এন্টারপ্রাইজের দরের অনুমোদন দেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) ড. এ বি এম খালেদুজ্জামান।
দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামারে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খাদ্য উপকরণ হিসেবে গমের ভুসি ও টেক্সিন বাউন্ডার সরবরাহের টেন্ডারে (জিআর-১ টেন্ডার নম্বর ৮২৫৪০৬) ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেটাগা ট্রেডার্স ১ কোটি ৬ লাখ ৬০ হাজার ৬৮৩ টাকা দর দেয়। আর একই কাজের জন্য মেসার্স করিম ট্রেডার্স টেন্ডারে দর দেয় ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬৭ হাজার ৬৪০ টাকা। বেটাগার চেয়ে ৩০ লাখ ৬ হাজার ৯৫৬ টাকা বেশি দর দিলেও টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি করিম ট্রেডার্সকেই কার্যাদেশ প্রদানের সুপারিশ করে। ফলে তারাই কাজটি পায়। আইন–কানুন ও নিয়ম-নীতির নানা ফাঁক গলে টেন্ডারের সঙ্গে জড়িত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও স্থানীয় কার্যালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কেবল জিআর-১ ও জিআর-৩ এর খাদ্য সরবরাহেই অর্ধকোটি টাকার বেশি লোপাট হয়েছে বলে অভিযোগ। সম্প্রতি এ বিষয়ে দুদকে একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স করিম ট্রেডার্সের মালিক রবিউল করিম বলেন, ‘আামি গরু খামারে খাদ্য সরবরাহের জন্য একটি, মুরগির খামারে একটি ও ছাগল খামারে দুটি কাজ পেয়েছি। শুধু টেন্ডারে ড্রপ করলেই তো হবে না। শর্ত অনুযায়ী সকল কাগজপত্র থাকতে হবে। আমি প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই কাজগুলো পেয়েছি। কোনো অনিয়ম হয়নি।’
এ বিষয়ে দুদকের রাজশাহী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আমির হোসাইন বলেন, ‘অভিযোগটি অনুসন্ধানে অনুমতির জন্য প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে মুরগির খামারে খাদ্য সরবরাহে কিছুদিন আগে তিনটি গ্রুপে প্রায় সোয়া কোটি টাকার টেন্ডার আহ্বান করা হয়। কিন্তু টেন্ডারে নতুন নতুন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে কথিত সিন্ডিকেটের বাইরের ঠিকাদাররা অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কর্মকর্তাদের এমন কাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে সম্প্রতি সদর উদ্দিন নামের একজন ঠিকাদার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেছেন। আগামী ২৯ জুলাই রিটের শুনানির তারিখ ধার্য রয়েছে। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেনের বেঞ্চ এই তারিখ ধার্য করেন।
রিটকারী ঠিকাদার সদর উদ্দিন বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে আমি খাদ্য সরবরাহ করে আসছি। কিন্তু এবার টেন্ডারে এমনভাবে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে আমার মতো ঠিকাদারেরা অংশগ্রহণ করতে না পারেন। ঢাকা থেকে ঠিকাদার এনে টেন্ডার ড্রপ করানো হয়েছে। সিস্টেমে ফেলে আর স্থানীয় ঠিকাদারদের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এটা দুর্নীতি। আইনের বাইরে গিয়ে কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এ কারণে আমি হাইকোর্টে গিয়েছি।’
অপর দিকে ৯ জুন সরকারি ছাগল উন্নয়ন খামারে খাদ্য উপকরণ সরবরাহের জন্য প্রায় ৪৫ টাকা মূল্যের দরপত্র আহ্বান করা হয়। তাতে জিআর-১ গ্রুপে সয়াবিন খৈল, ছোলা, ভুট্টা ও ওষুধ প্রিমিক্স ডিবি এবং জিআর-২ গ্রুপে গমের ভুসি, খেসারির খোসা ও ওষুধ ডিপি সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। ২৪ জুন দরপত্র দাখিলের শেষদিন। কিন্তু ঠিকাদারদের অভিযোগ, এত দিন ওষুধ আলাদা টেন্ডারে কেনা হতো। কিন্তু এবার পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে কতিপয় কর্মকর্তা খাদ্যের সঙ্গেই ওষুধ সরবরাহের দরপত্র আহ্বান করেছেন। যাতে নির্দিষ্ট কয়েকজন ঠিকাদার ছাড়া বাকিরা টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে না পারেন।
এ বিষয়ে মেসার্স রিফাত ট্রেডার্সের মালিক আবুল কাশেম বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরেই আলাদাভাবে খাদ্যের টেন্ডার করা হতো। কিন্তু এবার একসঙ্গে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। কারণ, টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী ওষুধ সরবরাহে ওই সিন্ডিকেট ছাড়া বাকি ঠিকাদারদের যোগ্যতা নেই। টেন্ডারের নামে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিতে টেন্ডার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে কাজটি করেছেন। ফলে রানিং যাঁরা ঠিকাদার, তাঁরা টেন্ডার ড্রপ করতে পারছেন না। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হচ্ছে। এসব অনিয়মের প্রতিকার চাই আমরা।’