১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, বুধবার, ০২:৫২:৪৫ অপরাহ্ন
একাধিক ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ এএমডি শফিউজ্জামানের বিরুদ্ধে
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-১২-২০২৪
একাধিক ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ এএমডি শফিউজ্জামানের বিরুদ্ধে

অনিয়মের মাধ্যমে দুটি ট্রাভেল এজেন্সিকে প্রায় ৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংক এশিয়া। পরে সে ঋণ নিয়ে পালিয়ে যান গ্রাহক। এসব ঋণ অনুমোদন দেন ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) শফিউজ্জামান। নানা উপায়ে কিছু টাকা ফেরত এলেও এখনো সাড়ে ৭ কোটি টাকার কোনো হদিস নেই। বর্তমানে সে টাকা খেলাপি দেখানো হচ্ছে। এ ঘটনায় ব্যাংক এশিয়ার অভ্যন্তরীণ তদন্তে সংশ্লিষ্ট শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের ৯ জনকে দায়ী করা হয়। এর মধ্যে শফিউজ্জামানও রয়েছেন। কিন্তু শুধু শাখা ব্যবস্থাপককে চাকরিচ্যুত করা হয়। বাকিরা বহাল তবিয়তে। শুধু তাই নয়, শফিউজ্জামানের বিরুদ্ধে ঋণ অনিয়মের আরও অভিযোগ রয়েছে। একের পর এক ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় তার নাম উঠে এলেও অজানা কারণে তিনি থাকছেন শাস্তির বাইরে। এবার পেতে যাচ্ছেন আরও বড় পুরস্কার। ব্যাংক এশিয়ার এএমডি থাকাবস্থায় তিনি চেষ্টা চালাচ্ছেন এসআইবিএলের এমডি হওয়ার জন্য। এ পথে অনেকটা এগিয়েও গেছেন।


ইসলামি ব্যাংকিং নীতিমালা পাশ কাটিয়ে শরিয়াহভিত্তিক সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ পেতে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন তিনি। ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে আবদ্ধ এই বিতর্কিত কর্মকর্তাকে এমডি নিয়োগ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন জানিয়েছে স্বয়ং এসআইবিএলের পরিচালনা পর্ষদ। তবে নীতিমালা পরিপন্থি এই নিয়োগ অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগে চলছে তোলপাড়।


কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের এমডি হতে কমপক্ষে ৩ বছর যে কোনো ইসলামি ব্যাংকে চাকরি করার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। ইসলামী ব্যাংকিং নীতিমালায় এ শর্তটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে বিভাগ থেকে ব্যাংকের এমডি নিয়োগ অনুমোদন হয় সেই বিভাগের একজন সাবেক পরিচালক আছেন এসআইবিএলের পর্ষদে। তবুও এসআইবিএলের বোর্ডের এমন অভিনব আবেদন নিয়ে বিব্রত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।


জানা গেছে, ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে নিয়োগ অনুমোদন পেতে আবেদন করেছিল এসআইবিএল। তবে এখনো অনুমোদন না দেওয়ায় জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।


একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো ইসলামি ব্যাংকিং নীতিমালার আলোকে পরিচালিত হয়। এটি আইন না হলেও এর মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকগুলো চলে। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব নীতিমালার পরিপন্থি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা যুগান্তরকে বলেন, ‘ইসলামি ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও বিশেষ বিবেচনায় ব্যাংকটির পক্ষ থেকে একজনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে।’


সার্বিক বিষয় জানতে শফিউজ্জামানের মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি, এমনকি খুদে বার্তায় ফোন করার কারণ উল্লেখ করেও কোনো সাড়া মেলেনি।


শফিউজ্জামানের অভিনব ঋণ জালিয়াতি


দুদকের অভিযোগ ও ব্যাংকের নথি ঘেঁটে জানা যায়, মেসার্স এসএন ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মালিক মোহাম্মাদ শাহ আলম। তিনি ব্যাংক এশিয়ার জুরাইন শাখার একজন গ্রাহক। এ প্রতিষ্ঠান হজ ব্যবস্থাপনা তথা হাজিদের হজে পাঠানো এবং উড়োজাহাজের টিকিট বিক্রি করে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালে প্রায় এক হাজার ব্যক্তিকে হজে পাঠানোর কথা বলে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ঋণ নেয়। তবে কাউকে হজে না পাঠিয়ে দেশত্যাগ করেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক শাহ আলম। তিনি শুধু হজে গমন প্রত্যাশীদের টাকাই গায়েব করেননি, ব্যাংক এশিয়ারও সাড়ে ৪ কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন। ঋণ নিয়েছেন ভুয়া জামানতে। ব্যাংকটি এখন ঋণ ফেরত পাচ্ছে না আবার জামানতও বেহাত হয়ে গেছে।


বিষয়টি তদন্তের জন্য ওই বছরের (২০২৩ সাল) সেপ্টেম্বরে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগ দাখিল হয়েছে। অভিযোগ আমলে নিয়েছে দুদক। বর্তমানে তদন্তকাজ চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। অভিযোগপত্র বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্যাংক এশিয়ার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচাক ও মুখ্য ঋণ কর্মকর্তা শফিউজ্জামান প্রতিষ্ঠানটিকে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ অনুমোদন করেন। ঋণের বার্ষিক সুদ ধরা হয় ৯ শতাংশ। ব্যবসায়িক খরচ মেটাতে ১২০ দিনের জন্য ঋণের জামানত রাখা হয় চলতি হিসাবের (হিসাব নং-১৫৫৩৩০০০৮৬৩) ৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। যা ব্লক (স্থগিত) রাখার শর্ত আরোপ করা হয়। তবে পরে জালিয়াতির লক্ষ্যে চলতি হিসাবের পরিবর্তে গ্রাহকের এসএনডি হিসাব (নং ১৫৫৩৬০০০০৬৩) ব্লক রাখার শর্ত আরোপ করা হয়। মূলত শফিউজ্জামানের সঙ্গে গ্রাহক শাহ আলমের যোগসাজশে জামানত পরিবর্তন করা হয়।


ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি হজযাত্রীর অনুকূলে দুই লাখ টাকা একটি এসএনডি হিসাবে জমা রেখে তা ব্লক রাখতে হয়। অভিনব জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক এশিয়া থেকে সাড়ে ৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ওই টাকা এসএনডি হিসাবে রাখা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, হিসাবটি ব্লকও করা হয়। অপরদিকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশে ব্লক করা হিসাবটি ব্যাংক ঋণের জামানত হিসাবেও রাখা হয়। অর্থাৎ ঋণের টাকায় জামানত পূর্ণ করা হয়। অথচ এই জামানতটি ছিল ভুয়া, যা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পাওনা টাকা। পরে নিয়ম অনুযায়ী, এই হিসাব থেকে টাকা কেটে নেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। ফলে ব্যাংকের ঋণ ও জামানত সবই হাতছাড়া হয়ে যায়। ঋণগ্রহীতা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকের পুরো ঋণটি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।


জানা গেছে, শফিউজ্জামানের নির্দেশনায় তার অধীন কর্মকর্তা তাহমিদ রশীদ (হেড অব রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগ) এবং মুরাদ মোহাম্মাদ (ডেপুটি হেড অব রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগ) ঋণটি অনুমোদন দেন। এমনকি ঋণটি অনুমোদন করার আগে প্রধান কার্যালয়ের ঋণ সভাতেও উত্থাপন এবং অনুমোদন করা হয়নি। বিজনেস ডিপার্টমেন্টের অনুমোদন ছাড়াই শফিউজ্জামানের একক ক্ষমতায় ঋণটি ছাড় করা হয়। জালিয়াতি ধরা পড়ার ভয়ে গোপনে ঋণটি অনুমোদন ও ছাড় করেন শফিউজ্জামান।


ব্যাংক সূত্রের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ঘটনার তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে চিঠি দেন দুদকের অভিযোগ সেলের পরিচালক উত্তম কুমার মণ্ডল। এছাড়া ঘটনাটি তদন্তের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগও। ২০২৩ সালের ৩ আগস্ট চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল জানায়, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিতরণকৃত ঋণটি তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এর প্রেক্ষিতে তদন্ত পরিচালনা করে ব্যাংক এশিয়া। তদন্তে অভিযোগের চেয়েও বড় জালিয়াতি ধরা পড়ে। হজ প্যাকেজের আওতায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের অভিযোগ থাকলেও বাস্তবে মাত্র ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা জামানত রেখে ৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা ঋণ বাগিয়ে নেয় শাহ আলমের এসএন ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরস কোম্পানি এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট অপর প্রতিষ্ঠান এভিয়ানা ট্রাভেলস। এতে জামানত ঘাটতির কারণে ব্যাংকটির ৭ কোটি ৬০ লাখ টাকারও বেশি ঋণ ঝুঁকিতে পড়ে যায়। বর্তমানে পুরো ঋণই এখন খেলাপি।


জানা গেছে, তদন্ত প্রতিবেদনটি ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ এবং বোর্ড সেক্রেটারিয়েটে জমা পড়লেও ক্ষমতার দাপটে ধামাচাপা দেন শফিউজ্জামান।


তবে এ ঘটনায় চাকরিচ্যুত হয়েছেন ব্যাংক এশিয়ার সংশ্লিষ্ট শাখা ব্যবস্থাপক হাসান আলী গাজী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘তদন্তে মোট ৯ জনকে দায়ী করা হয়েছিল। সেখানে মুখ্য ঋণ কর্মকর্তা শফিউজ্জামানের নামও ছিল। কিন্তু রহস্যজনকভাবে শুধু আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, বাকি সবাই বহাল আছেন।’


এদিকে পর্যাপ্ত জামানত না থাকলেও লবিস্ট নিয়োগ করে ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা ঋণ দেন শফিউজ্জামান। কমিশনবাণিজ্য চলে কনসালট্যান্সি ফার্মের আড়ালে।


নিজের ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয় ইনস্পিরিজেন্স সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএসএল) নামের এই লবিস্ট প্রতিষ্ঠান। দেড় থেকে দুই শতাংশ কমিশনের শর্তে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার চুক্তি করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি। ১০০ টাকার সরকারি স্টাম্পে এলিট পেইন্ট অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা চুক্তিতে দেখা যায়, প্রথম ৫০ কোটিতে দুই শতাংশ হারে কমিশন এবং এর বেশি পরিমাণের ক্ষেত্রে দেড় শতাংশ হারে কমিশনের শর্তে চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ব্যাংক এশিয়া থেকে এলিট পেইন্টকে ঋণ পাইয়ে দিতে তদবির করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি। আপন ভাই ব্যাংক এশিয়ার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউজ্জামানের মাধ্যমে ১৪০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করিয়ে নেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির (আইএসএল) এমডি মাহবুবুজ্জামান। শর্ত অনুযায়ী, দুই কোটি ৯ লাখ টাকা কমিশন ভাগাভাগি করেন দুই ভাই। মাহবুবুজ্জামানের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে প্রথম দফায় ৩০ লাখ টাকা ও দ্বিতীয় দফায় ১৫ লাখ টাকা লেনদেন হয়। বাকি এক কোটি ৬৪ লাখ টাকা নগদে লেনদেন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ব্যাংক এশিয়ার উত্তরা শাখায় এলিট পেইন্ট অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি নামে এক প্রতিষ্ঠান প্রায় ১৪০ কোটি টাকা ঋণের জন্য আবেদন করে। তবে প্রতিষ্ঠানটি তাদের যোগ্যতা অনুসারে ঋণ না পাওয়ায় অসদুপায় অবলম্বন করে।


শেয়ার করুন