শিক্ষাপঞ্জি মেনে আগামীকাল বুধবার সারা দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাবর্ষ শুরু হচ্ছে। গতবারের মতো এবারও থাকছে পাঠ্যবইয়ের ঘাটতি। বছরের প্রথম দিন সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দিতে ৪০ কোটি ১৬ লাখ পাঠ্যবই প্রয়োজন। ছাপাখানার মালিক, মুদ্রণ শিল্প সমিতি ও এনসিটিবি সূত্র জানায়, গতকাল সোমবার পর্যন্ত প্রায় ৭ কোটি পাঠ্যবই ছাপা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ কোটি বই উপজেলা পর্যায়ে পাঠানোর জন্য ছাড়পত্র বা পিডিআই হয়েছে। এখনো ৩৩ বই ছাপানোই বাকি। ফলে এবার নতুন বছরের প্রথম দিনে সারা দেশে সব শিক্ষার্থী সব বই পাবে না।
ছাপাখানাগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১১৬টি ছাপাখানায় ২৪ ঘণ্টা বিরামহীন পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। তবে ছয় মাসের কাজ এক মাসে শেষ করতে সরগরম ছাপাখানাগুলো। কোনো ফুরসত নেই শ্রমিকদের। মিনিটে মিনিটে বেরিয়ে আসছে ছাপা কাগজ। অন্যপাশে চলছে বাঁধাইয়ের কাজ। ২০২৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু হয়েছিল। তারপরও সবার হাতে সব বই পৌঁছাতে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এবার মাধ্যমিকের পাঠ্যবই ছাপাতে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যাদেশ (নোটিশ অব অ্যাওয়ার্ড বা নোয়া) দেওয়া হয় ১০ ডিসেম্বর থেকে। কাগজসংকট না থাকলে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৪০ লাখ কপি পাঠ্যবই পাঠানোর সক্ষমতা আছে ছাপাখানাগুলোর।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানিয়েছে, এবার প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের বইয়ের সংখ্যা ১২ কোটি ৮ লাখ ৬৭ হাজার ৭৫২টি। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির অর্থাৎ মাধ্যমিক পর্যায়ের বইয়ের সংখ্যা ২৮ কোটি ৬ লাখ ২২ হাজার ৩৩৭টি। তাছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে ৮ হাজারের বেশি ব্রেইল বই ছাপা হচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষকদের জন্য দেওয়া হবে প্রায় ৪১ লাখ ‘শিক্ষক সহায়িকা’। জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি ছাপাখানায় এনসিটিবির মনিটরিং টিম সার্বক্ষণিক অবস্থান করছে।
এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, ছাপাখানাগুলো ২৪ ঘণ্টা বই ছাপাচ্ছে। তবে সময় স্বল্পতার কারণে তারা কতটুকু পেরে উঠবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। বছরের প্রথম দিন প্রাথমিকের সব বই এবং মাধ্যমিকের বাংলা, অঙ্ক ও ইংরেজি বই সবার হাতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে তারা কাজ করছেন। কিন্তু বই ছাপার যে পরিস্থিতি, তাতে সেই পরিকল্পনাও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
এনসিটিবি ও মুদ্রণকারী সূত্র জানায়, প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই ছাপায় অগ্রগতি ভালো। অনেক উপজেলায় ইতিমধ্যে এ তিন শ্রেণির বই পাঠানো হয়েছে। চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার অগ্রগতি কম।
ছাপাখানার মালিক, মুদ্রণ শিল্প সমিতি ও এনসিটিবি কর্মকর্তারা বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, পাঠ্যবই পরিমার্জন, আগের দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র দেওয়া, দেরি করে পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করা, বিলম্বে নোয়া (নোট অব অ্যাওয়ার্ড) দেওয়াসহ ছাপাসংক্রান্ত কাজে বিলম্বের কারণে এবার এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখনো বেশ কিছু পরিমাণ বই ছাপার জন্য মুদ্রণকারীদের সঙ্গে চুক্তিপত্র সইয়ের কাজটিও শেষ হয়নি। ফলে আগামী মার্চ মাসের আগে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই পৌঁছানো কঠিন হবে।
জানা গেছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন শিক্ষাক্রম কার্যত বাতিল হয়ে গেছে। এরপর এক যুগ আগে তৈরি পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে জন্য এবার বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ৪৪১টি বই পরিমার্জন করে এনসিটিবি। এ প্রক্রিয়ায় পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ে বেশ কিছুসংখ্যক গদ্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা বা বিষয়বস্তু বাদ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন করে স্থান পাচ্ছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিষয়বস্তুসহ নতুন কিছু গল্প-কবিতা। পুরোনো শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ায় এবার মোট বইয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। তারপরও বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীরা যাতে কিছু বই হাতে পায়, সেই চেষ্টা করছে এনসিটিবি। সেজন্য ষষ্ঠ থেকে দশম পর্যন্ত প্রত্যেক শ্রেণির কিছু প্রয়োজনীয় বই আগে ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, টেন্ডার আহ্বান করে নোয়া (নোট অব অ্যাওয়ার্ড) পাওয়ার ২৮ দিনের মধ্যে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে কাজের চুক্তি করতে হয়। সেই হিসাবে তারা ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত চুক্তি করতে পারবে। এরপর বই ছাপার জন্য নিয়মিত ৪০ দিন সময় অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জরিমানা ছাড়াই বই সরবরাহ করতে পারবে। আর জরিমানাসহ আরও ২৮ দিন ধরলে মার্চের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় পাওয়া যাবে।
পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্শন উদ্বোধন কাল: বিগত দুই-তিন বছর শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ১ জানুয়ারি উৎসব করে বই বিতরণ শুরু হলেও কিছু ক্ষেত্রে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব নতুন বই দেওয়া যায়নি। আসন্ন শিক্ষাবর্ষে উৎসব করে বই দেওয়া হবে না। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রায় ৭৭ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বই উৎসবের নামে। অপ্রয়োজনীয় খরচ এড়াতে ‘বই উৎসব’ বাতিল করা হয়েছে এবার। শুধু পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্শন উদ্বোধন করবে সরকার। আগামী ১ জানুয়ারি সকাল ১০টায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এনসিটিবির ওয়েবসাইটে পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্শন উদ্বোধনের প্রস্তুতি ইতিমধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। অপরদিকে আনুষ্ঠানিকতা না থাকায় নিজ নিজ স্কুলে প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য এবং স্থানীয় প্রশাসনের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া হবে। আলাদা করে কোনো অনুষ্ঠান করা হবে না।