১৪ মার্চ ২০২৫, শুক্রবার, ০১:০৭:৩৪ পূর্বাহ্ন
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেভাবে চলছে অপরাধ সাম্রাজ্য
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৩-২০২৫
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেভাবে চলছে অপরাধ সাম্রাজ্য

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় চলছে জমজমাট অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা। মানব পাচারের ঘটনাও আছে। গত সাত মাসে ১৬টি অস্ত্র মামলায় ২৩ জনকে গ্রেফতার করেছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্যরা। 


তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের মধ্যে ছিল ওয়ান শুটারগান ২৪টি। একই সময়ে ৩১টি মাদক মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ৩৫ জনকে। উদ্ধার করা হয়েছে আইস-ক্রিস্টাল মেথ, ইয়াবাসহ বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য। এর মধ্যে ইয়াবার সংখ্যাই ৭০ হাজার পিস।


বাংলাদেশি দুষ্টচক্র ও চোরাচালানিদের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে এসব অপরাধকাণ্ড ঘটাচ্ছে রোহিঙ্গা অপরাধীরা।  


যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে আরও জানা গেছে, এসব ক্যাম্পে আগ্নেয়াস্ত্র আসছে মিয়ানমার থেকে। পাশাপাশি অস্ত্র তৈরি হচ্ছে কক্সবাজারের মহেশখালীসহ বিভিন্ন স্থানেও। এসব অস্ত্রই কাজ করছে আধিপত্য লড়াইয়ের মূল চালিকাশক্তি হিসাবে। 


গ্রুপগুলো হলো-আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি), আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন), আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি (এআরএ), নবী হোসেন গ্রুপ (গ্রুপপ্রধান নিহত), মাস্টার মুন্না গ্রুপ, দীল মোহাম্মদ ওরফে মার্স গ্রুপ, ডাকাত সালমান গ্রুপ ও ডাকাত সাদ্দাম গ্রুপ। এসব গ্রুপের তৎপরতায় ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ২০২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কেবল আরসা, আরএসও এবং এআরএ-এর মধ্যে গ্রুপিংয়ের কারণেই ৬৭ ভাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।


কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় অবস্থিত ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্যের লড়াই যেন ‘স্থায়ী সংস্কৃতিতে’ পরিণত হয়েছে। অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই মূলত এ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি, যা এখনো অব্যাহত। গত ৪ বছরের বিভিন্ন সময়ে আটটি গ্রুপের মধ্যে সংঘটিত এসব ঘটনায় অন্তত ২০২ জন খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন অসংখ্য।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর প্রতিমাসেই গড়ে একটি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। গত সাত মাসে ঘটেছে আটটি। সবশেষ ৮ মার্চ উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত হন। ওইদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে উখিয়া উপজেলার বালুখালী ৮-ইস্ট নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র সংগঠন আরসা ও আরএসও সদস্যরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে ওই রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ রফিক (৩৩) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।


জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি। তাদের যুগের পর যুগ হত্যা-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে। ক্যাম্পগুলোয় অসংখ্য যুবক আছে, যারা নিজ চোখে তার মা-বোনকে ধর্ষিত হতে, বাবাকে হত্যা করতে দেখেছেন-এ ধরণের জনগোষ্ঠীকে পাহারা দিয়ে রাখা নিঃসন্দেহেই জটিল একটি বিষয়। 


তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের একটি অংশ বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেছে। ইয়াবা চোরাচালন এবং অবৈধ অস্ত্রই রোহিঙ্গাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের মূল কারণ। যেহেতু ক্যাম্প থেকে পাঁচ কিলোমিটার ওপারেই যুদ্ধ হচ্ছে, তাই সহজেই অনুমেয় অস্ত্র কোথা থেকে আসছে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকেই অস্ত্র সংগ্রহ করছে। মহেশখালীসহ কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানেও আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশি দুষ্টচক্র ও চোরাচালানিদের সঙ্গে রোহিঙ্গা অপরাধীদের একটি সংযোগ আছে।


প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর-১১ মাসে ১০৯টি অস্ত্র মামলায় ১৩৮ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করেছেন এপিবিএন সদস্যরা। ১৫৪টি মাদক মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ১৮৫ জনকে। ৪৪টি হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন ২৯ রোহিঙ্গা। ওই ১১ মাসে অন্যান্য ঘটনায় আরও ৩৮৮ রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করেছে এপিবিএন। গত চার বছরের হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি ৭৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ২০২০ সালে ১০, ২০২১ সালে ৩০, ’২২ সালে ৩১ এবং ’২৪ সালে ৫৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।


জানতে চাইলে এপিবিএন ডিআইজি (এফডিএমএন) প্রলয় চিসিম যুগান্তরকে বলেন, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা এবং ব্যবসার টাকা ভাগবাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করেই মূলত রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। এছাড়া ভূরাজনৈতিক কারণ তো আছেই। 


কীভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা চলছে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্যাম্পগুলোর অবস্থান মিয়ানমার সীমান্তের দুই-চার-পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে। পুরো সীমান্তে তো সব সময় পাহারা দেওয়া সম্ভব হয় না। সীমান্ত রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের দুর্বলতা এবং কিছু স্থানীয় অপরাধীর যোগসাজশেই ওপার থেকে মাদক-অস্ত্র আসছে। এক প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি বলেন, গত সাত মাসেও ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা দেশে ঢুকেছে।


শেয়ার করুন