০৯ জুন ২০২৫, সোমবার, ০৯:৪৯:০০ অপরাহ্ন
নির্বাচন নিয়ে দড়ি–টানাটানি, সাধারণ মানুষ কী চাইছে
স্টাফ রিপোর্টার :
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৬-২০২৫
নির্বাচন নিয়ে দড়ি–টানাটানি, সাধারণ মানুষ কী চাইছে

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন-তারিখ নিয়ে দড়ি–টানাটানিতে পড়ে জাতি আলোচনার ফুরসত পাচ্ছে না, আমজনতা তাদের ভাবী প্রতিনিধি ও সম্ভাব্য নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে কী আশা করছে।

রাজনৈতিক দলের বাইরেও গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, অধিকারকর্মী ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে আজকের ভোটাররা কী চায় এবং তাদের সমবেত কল্যাণে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, সেই দাবিনামা এবং নিদেনপক্ষে প্রত্যাশার ফর্দ এখন পর্যন্ত প্রস্তুত করা হয়নি।

৬ জুন সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ঘোষণা দেন, তা নিয়ে বক্তৃতামঞ্চে বিতর্ক যা–ই হোক, দেশ কার্যত নির্বাচনমুখীই হবে। শিগগিরই হয়তো দল ও অংশীজনকে তাদের জনসংযোগের কৌশল ঠিক করতে ব্যস্ত দেখা যাবে।

গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনে জেতার জন্য রাজনীতিবিদেরা সাধারণত কিছু কাজ করে থাকেন। যেমন তাঁরা জাতীয় ও স্থানীয় সমস্যার কিছু সমাধানের চেষ্টা করেন; তাঁরা মানুষের উপকারে আসে—এমন কিছু উদ্যোগ নেন (বা লোকদেখানো উপকার করতে চান); তাঁরা বিরোধী দলের ভুল বা দুর্বলতা ধরে প্রচার চালান; তাঁরা কখনো কখনো খুব আক্রমণাত্মক বা উসকানিমূলক ভাষা ব্যবহার করেন। এসবই তাঁরা করেন ভোটারদের কাছে নিজেদের পছন্দের প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরার জন্য।


বাংলাদেশে সামনে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটা একেবারে নতুন এক পরিস্থিতিতে হতে যাচ্ছে।

একদিকে আছে ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় ঘটে যাওয়া হত্যা, দুর্নীতি ও অন্য অপরাধগুলোর বিচার করা এবং যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে, সেগুলোকে আবার গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করা।

আরেক দিকে আছে ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষের যেসব আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেই চাওয়াগুলোর প্রতিফলন ঘটানো।
এই দুদিক মিলিয়েই এ নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।

সরকার যতই আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা তৈরির চেষ্টা করুক, আর রাজনৈতিক দলগুলো ভোট পেতে যত কৌশলই নিক না কেন; যদি সাধারণ মানুষের আসল সমস্যা ও চাওয়া-পাওয়া নিয়ে সমাজে খোলাখুলি আলোচনা না হয়, আর সেই বিষয়ে জনমত না গড়ে ওঠে, তাহলে সেগুলো উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

সাধারণ মানুষের জন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আনা দরকার, সেগুলোর মধ্যে হতে পারে: তরুণদের মেধা বিকাশ ও সাফল্যের সুযোগ সৃষ্টি, ভালো চাকরি ও নিজের ব্যবসা শুরু করার সুযোগ, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষকে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠা, চাঁদাবাজি আর ঘুষ বন্ধ করা, সন্ত্রাস ও ভয়ভীতির রাজত্ব যাতে না গড়ে ওঠে সে ব্যবস্থা করা, সবার জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ তৈরি, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, রাস্তাঘাটে যাতায়াতে দুর্ভোগ কমানো, বাসযোগ্য শহর গড়ে তোলা, আবাদি জমি ও পরিবেশ রক্ষা করা, নাগরিক অধিকার বাস্তবায়নে বাধা দূর করা এবং এমন এক রাষ্ট্রনীতি গড়া, যা সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে ও নিজের বলেই ভাবতে পারে।

এসব বিষয় যদি নির্বাচনের সময় গুরুত্ব না পায়, তাহলে ভোটের মানে শুধু ক্ষমতা দখলের খেলা হয়ে দাঁড়াবে—মানুষের জীবনের আসল সমস্যাগুলো উপেক্ষিত থেকেই যাবে।

কোনো কোনো সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী এমনও ভাবতে পারেন—জনস্বার্থের এসব বিষয় (যেমন চাকরি, শিক্ষা, পরিবেশ, ন্যায়বিচার ইত্যাদি) নিয়ে কথা বলা বা জাতীয় পর্যায়ে ঐক্য ও জনকল্যাণের কথা বলার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ভোট পাওয়ার কী সম্পর্ক?
কারণ, তাঁকে তো আগে দল থেকে মনোনয়ন পেতে অনেক চেষ্টা করতে হয়, অনেক সময় টাকা খরচ করে এলাকায় প্রচার চালাতে হয়।

তাঁর মনে হতে পারে, এলাকার বেশির ভাগ মানুষ যদি যেকোনো কারণেই (দল, পরিচিতি বা প্রভাব দেখে) তাঁকে ভোট দেয়, তাহলে বড় বড় ইস্যু নিয়ে ভাবার দরকারই–বা কী? তাঁকে কে ঠেকাবে নির্বাচনে জিততে?

এভাবে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে একটি দল টেনেটুনে ১৫১টি পেলেই তো সরকার গঠনে আর কোনো বাধা থাকছে না। সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারপ্রধান হতে প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির মতো জনপ্রিয়তার পরীক্ষায় পাস করে আসতে হয় না।

বহুদলীয় নির্বাচনে বিজয়ী দলের এক দিনের মোটামুটি জনপ্রিয়তা এবং প্রয়োজনে কায়দাকানুন করে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের সুযোগ থাকলে নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে ভালো ভালো প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কী দরকার?


এর তাৎক্ষণিক উত্তর একেবারেই জানা নেই আমাদের। কারণ, গত দেড় দশকে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ ও পরিবেশ না থাকায়, এবারের ভোটাররা কেমন আচরণ করবে তা আগেই বলা যাচ্ছে না। ২০০১ সালের পর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া প্রজন্মসহ সর্বসাম্প্রতিক ভোটারদের মনোভাব সম্পর্কেও আমাদের তেমন কোনো ধারণা নেই।

ধরা যাক, কোনো প্রার্থী বা দল নির্বাচন জিততে ইশতেহার বা ভোটারদের একগাদা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না, তাতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম কি বিনা প্রত্যাশা ও আশ্বাসে ভোট দিয়ে দেবেন? আপনি বা আপনারা সরকারি দলে গেলে বিরোধী পক্ষ নিজস্ব রাজনীতির তাগিদেই কি জন-আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরে মাঠে নামবে না?


একটি দেশের মানুষ যেমন ধরনের নেতা বেছে নেয়, তেমনি নির্বাচনের আগের পরিবেশও অনেক কিছু বলে দেয়—এই নির্বাচন কতটা ভালো বা খারাপ হতে যাচ্ছে। ভোট মানে শুধু ভোটের দিন নয়—এর মধ্যে পড়ে প্রার্থী কে হবেন, জনগণ কেমন করে অংশ নেবে, প্রচার চালানো হবে কেমন করে, ভোট দেওয়ার প্রক্রিয়া কী হবে এবং শেষ পর্যন্ত কেমন প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হচ্ছেন। পুরো এই প্রক্রিয়াই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার নাম ভোট।

১৯৯০ সালের গণ–অভ্যুত্থানের পর অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জন-আকাঙ্ক্ষা ও তিন জোটের রূপরেখার চাপ ছিল প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ওপর। সেটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং সংসদও ছিল প্রাণবন্ত।

নেতিবাচক দৃষ্টান্তও আছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোটের নির্বাচনী সংগীত এতটাই কর্কশ ও বিরক্তিকর ছিল যে মনে হচ্ছিল, জনগণকে বার্তা দেওয়া হচ্ছে যেন তারা ভোটকেন্দ্রেই না যায়। আগের রাতে ব্যালট বাক্স বোঝাই করায় সেই নৈশকালীন নির্বাচনে সত্যিই মানুষের ভোটের প্রয়োজন পড়েনি।

এবার ভালো একটি নির্বাচন করতে হলে অবশ্যই অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৃহত্তর জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য থাকতে হবে।

তাই বলে নির্বাচকমণ্ডলীকে বাদ দিয়ে কোনো আয়োজন করা হলে তা টেকসই বা গ্রহণযোগ্য হবে ভাবাটা বরং হবে পতিত শেখ হাসিনার পরাজিত চিন্তা।

অধ্যাপক ইউনূস সরকারের উদ্যোগে নেওয়া সংস্কার কার্যক্রমে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন আছে, কিন্তু সংস্কারের প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে স্থান না পেলে সেগুলো কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।

জন-আকাঙ্ক্ষাকে পাশ কাটিয়ে দলও চূড়ান্তভাবে ভালো ফল পাবে, সে নিশ্চয়তা কম। কারণ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ ভোটের দিন বা ৫ আগস্টের মতো পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়।

অধ্যাপক ইউনূস তাঁর ভাষণে জনগণকে আহ্বান জানিয়েছেন যাতে তারা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করে। যেমন তিনি বলেন, ‘আপনারা তাঁদের কাছে অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন যে তাঁরা সম্পূর্ণ সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করবেন এবং সকল প্রকার দুর্নীতি, দলীয়করণ, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেটবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি গণবিরোধী কাজ থেকে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখবেন।’

অবশ্য আমাদের দেশে জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মতামত গ্রহণের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন নেই বললেই চলে—রাজনৈতিক দল, এমনকি সরকারেরও না।
আসলে পশ্চিমের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রেও জনগণ নিজেরা সরাসরি শাসন করে না; শাসন করে একদল মানুষ—জনগণের নামে, জনগণের পক্ষে।

তাই জনগণের প্রতিনিধিদের সুশাসক বা রাষ্ট্র পরিচালনার সুব্যবস্থাপক হয়ে উঠতে রপ্ত করতে হয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। শখ করে হলেও জনগণের বোঝা মাথায় নিতে হয়, পরার্থপরতায়।

এবারের বাংলাদেশে সংস্কার ও ঐকমত্য এবং গণমানুষের রাজনৈতিক এজেন্ডা মানাই হচ্ছে সেই বোঝা।

পুরো জনগণ পল্টন ময়দানে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভে এসে সমবেত কণ্ঠে বলবে না যে এই ১০০টি তাদের দাবি, যদিও শত আকাঙ্ক্ষা রয়েছে তাদের।
তবে যেকোনো দল চাইলে জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের কথা শুনতে ও তালিকাভুক্ত করতে পারে, তাদের কল্যাণে কর্মসূচি নেওয়ার স্বার্থে। ২০২৬ সালের নির্বাচন সেই সুযোগ তৈরি করেছে।

আগামী জুলাই–আগস্ট মাসে যখন বিপ্লবের বর্ষপূর্তি পালন করা হবে, তখন সরকার, রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য গোষ্ঠী জনগণের সঙ্গে যৌথ সংলাপের আয়োজন করতে পারে। তাতে নির্বাচন নিয়ে, নির্বাচনের আগেই জনগণের চিন্তাভাবনা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

আজকের নতুন বাস্তবতায় নতুন করে নিজেদের মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি যে গণতান্ত্রিক সমাজে লেকচার দেওয়া নয়, গণমুখী রাজনৈতিক দলের কাজ হচ্ছে জাতীয় ইস্যু ও জনমত বুঝে জনকল্যাণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের দরবারে হাজির হওয়া।

শেয়ার করুন