০৮ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার, ০১:৩০:৫০ পূর্বাহ্ন
রিজিক খুজে বেড়াও রবের দেখানো পথে
সুমাইয়া কবীর, ওয়াশিংটন ডিসি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৭-২০২৫
রিজিক খুজে বেড়াও রবের দেখানো পথে

যান্ত্রিক এই জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত মানুষ এক অস্থির প্রতিযোগিতার মাঝে দৌড়ে বেরায়। এর অন্যতম কারন হল রিজিক অন্বেষণ। কিন্তু এই রিজিক অন্বেষণ যদি হয় আমার রবকে ভালোবেসে, যদি এটা হয় সেই মহান স্বত্তার দেখানো পথে তাহলে কতই না উত্তম রিজিক এর অধিকারি হয়ে যাই আমরা। 


ইসলাম আমাদেরকে এমনকিছু উপায় বলে দেয় যাতে করে আমার এই ছুটে চলা যেমন আমাদের দুনিয়ার প্রয়োজন মিটাবে তেমনি আমাদেরকে নিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর আরো নিকটে। 


রিজিক কি শুধুই দুনিয়াবি টাকা পয়শা?


রিজিক আমাদের বেতন বা ব্যবসায়িক লাভের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ বহন করে। এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, জ্ঞান, সম্পর্ক, সুযোগ এবং এমনকি আমাদের নিঃশ্বাসও। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) আমাদের কুরআনে স্মরণ করিয়ে দেন:


"আর পৃথিবীতে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহর। তিনি জানেন তাদের আবাসস্থল এবং অবস্থানস্থল। সবকিছুই স্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ।" (সূরা হুদ ১১:৬) 


এই আয়াত যে মৌলিক সত্য আমাদের সামনে তুলে ধরে তা হচ্ছে আমাদের রব , এই বিশ্ব জাহানের মালিক বহু পুর্বেই আমাদের জন্য রিজিক এর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমাদের তাকদীরে আমাদের জন্য রিজিক বরাদ্দ রয়েছে আমাদের কাজ হলো সেই রিজিক যথাযথ উপায়ে খুজে বের করা। সেই সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর সাথে আমাদের আত্মিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করা। 


রিজিক বৃদ্ধির ৪ টি উপায়-


১. তাকওয়াঃ


তাকওয়া, বা আল্লাহ ভীতি বরকতময় রিজিকের মূল ভিত্তি। এটি কেবলমাত্র আমাদেরকে পাপ থেকে বিরত রাখে না, বরং আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর উপস্থিতি সম্পর্কে উচ্চমানের সচেতনতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। 


আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআন  এ তাকওয়া এবং রিজিকের মধ্যে সুন্দর সংযোগ স্থাপন করে বলেছেন -


"আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য নিস্কৃতির পথ করে দেন। এবং তাকে এমন উৎস হতে রিজিক দেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না।" (সূরা তালাক ৬৫:২-৩)


এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার মুমিন বান্দাদের ওয়াদা করছেন , যারা আল্লাহর প্রতি তাকওয়াবান হবে তাদ্র জন্য অপ্রত্যাশিত রিজিক এর দুয়ার খুলে যাবে। 


তাকওয়ার ব্যবহারিক প্রয়োগ:


প্রতিদিন আপনার সকল কর্মক্ষেত্রে আল্লাহকে খুশি করার নিয়ত নিয়ে শুরু করুন


অসততা বা অন্যের ক্ষতি জড়িত এমন শর্টকাট এড়িয়ে চলুন


শুধু লাভজনক নয়, বরং সঠিক কাজের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিন


সারাদিন কাজের মাঝে আল্লাহকে বারবার স্মরণ করুন


২. তাওয়াক্কুলঃ 


তাওয়াক্কুল মানে অনেকের কাছে কোন কাজ না করে শুধু ভরশার নাম। মুলত তাওয়াক্কুল মানে আল্লাহর প্রজ্ঞার প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রেখে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই ভারসাম্যকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন:


"তোমার উট বেঁধে রাখো এবং আল্লাহর উপর ভরসা করো।" (তিরমিজি)


আরেকটি  হাদিসে বলা হয়েছে:


"তোমরা যদি আল্লাহর উপর যথাযথ ভরসা করতে, তাহলে তিনি তোমাদের পাখিদের মতো রিজিক দিতেন: তারা সকালে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বের হয় এবং সন্ধ্যায় পেট ভরে ফিরে আসে।" (তিরমিজি)


লক্ষ্য করুন যে পাখিরা তাদের বাসায় বসে খাবারের অপেক্ষায় থাকে না—তারা খাবারের সন্ধানে বের হয়, কিন্তু আল্লাহর উপর ভরসা করে যে তিনি তাদের জীবিকার পথ দেখাবেন।


তাওয়াক্কুলের ব্যবহারিক প্রয়োগ:


যত্নসহকারে পরিকল্পনা করুন এবং কঠোর পরিশ্রম করুন, কিন্তু নির্দিষ্ট ফলাফলের সাথে আবদ্ধ হবেন না


গুরুত্বপূর্ণ সভা বা সিদ্ধান্তের আগে দোয়া করুন


বিপত্তিগুলোকে আল্লাহর বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রহণ করুন


মনে রাখবেন যে আপনার প্রচেষ্টা হলো মাধ্যম, কিন্তু আল্লাহই চূড়ান্ত রিজিকদাতা


৩. ইয়াকীন: 


ইয়াকীন  মানে হল আল্লাহর প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা। এর মাধ্যমে বান্দা তার রবের প্রতি অটুট বিশ্বাস এর প্রদর্শন করে।  যখন আমরা সত্যিকারের বিশ্বাস করি যে আল্লাহ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন, তখন আমরা মানসিক শান্তি নিয়ে কাজ করতে পারি, এখানে জেনে রাখা দরকার যে আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা সর্বোত্তম উপায়ে পুরস্কৃত হবে।


"আর তিনিই আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, এবং এর মাধ্যমে আমি সব রকমের গাছপালা উৎপন্ন করি।" (সূরা আনআম ৬:৯৯)


আল্লাহ যেমন পৃথিবীকে শান্ত করতে নির্দিষ্ট সময়ে বৃষ্টি প্রেরণ করেন, তেমনি তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য তাঁর অসীম প্রজ্ঞা অনুযায়ী রিজিক প্রদান করেন। কুরআন আমাদের আরও বলে:


"আর আল্লাহ সর্বোত্তম রিজিকদাতা।" (সূরা জুমুআ ৬২:১১)


ইয়াকীনের ব্যবহারিক প্রয়োগ:


চিন্তা-উদ্বেগকে দোয়া এবং ইতিবাচক কর্মের সাথে প্রতিস্থাপন করুন


চ্যালেঞ্জগুলোকে উন্নতির সুযোগ হিসেবে দেখুন


বিশ্বাস রাখুন যে রিজিকে বিলম্ব হয়তো আপনাকে কোনো ক্ষতি থেকে রক্ষা করছে


মনে রাখবেন যে আল্লাহর সময়টাই সবসময় নিখুঁত


৪. ইস্তিগফার: প্রাচুর্যের দরজা


ক্ষমা প্রার্থনা (ইস্তিগফার) শুধুমাত্র অতীতের ভুলের বিষয় নয়—এটি একটি বিশুদ্ধ হৃদয়  তৈরি করতে সহযোগিতা করে। যে হৃদয় শুধুমাত্র রবের ভালোবাসায় ব্যাকুল থাকে। নবী নূহ (আলাইহিস সালাম) তাঁর সম্প্রদায়কে শিক্ষা দিয়েছিলেন:


"তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি পাঠাবেন, এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে বৃদ্ধি দেবেন, তোমাদের জন্য বাগান ও নদী-নালা সৃষ্টি করবেন।" (সূরা নূহ ৭১:১০-১২)


রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:


"যে ব্যক্তি ইস্তিগফারকে অভ্যাস করে নেয়, আল্লাহ তার জন্য প্রতিটি সমস্যার সমাধান এবং প্রতিটি দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির পথ তৈরি করেন, এবং তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না।" (আবু দাউদ)


ইস্তিগফারের ব্যবহারিক প্রয়োগ:


প্রতিদিন শুরু এবং শেষে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন


মানসিক চাপ বা উদ্বেগের সময় ইস্তিগফারকে রিসেট বাটন হিসেবে ব্যবহার করুন


নিজের করা ভুলের জন্য বারবার ইস্তগফার করুন


আপনার জিকির (আল্লাহর স্মরণ) এর নিয়মিত অংশ হিসেবে ইস্তিগফার করুন


যখন আমরা আমাদের রিজিক অন্বেষণের পদ্ধতিতে এই চারটি নীতিকে অন্তর্ভুক্ত করি, তখন বেশ কিছু সুন্দর পরিবর্তন ঘটে আমাদের জীবনে:


উদ্বেগের জায়গায়  শান্তি: ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্রমাগত চিন্তা করার পরিবর্তে, আমরা এই জানার মধ্যে প্রশান্তি খুঁজে পাই যে সবকিছু  আল্লাহর  নিয়ন্ত্রণে আছে।


নৈতিক স্বচ্ছতা: আমাদের সিদ্ধান্তগুলো কেবল লাভের হিসাবের পরিবর্তে রবের সান্নিধ্য  পাওয়ার জন্য হয়। 


অপ্রত্যাশিত সুযোগের আবির্ভাব: যখন আমরা আল্লাহর পথনির্দেশনার সাথে নিজেদের সংযুক্ত করি, তখন এমন দরজা খুলে যায় যা আমরা কখনো আশা করিনি।


কৃতজ্ঞতা বৃদ্ধি: আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতকে চিনতে শুরু করি।


মানসিক চাপের হ্রাস: আমাদের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এই চিন্তার বোঝা আমাদের কাঁধ থেকে নেমে যায় তখন আমাদের মানসিক চাপ ও কমে যায়। 


ইসলাম আমাদের প্রচেষ্টা এবং বিশ্বাসের মধ্যে নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রাখতে শেখায়। আমাদের পার্থিব উপায়-উপকরণ ত্যাগ করে নিষ্ক্রিয় বসে থাকার কথা নয়, আর আল্লাহকে ভুলে শুধুমাত্র নিজের ক্ষমতার উপর নির্ভর করারও কথা নয়। কুরআন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়:


"আর মানুষের জন্য তাই রয়েছে যার জন্য সে চেষ্টা করেছে।" (সূরা নাজম ৫৩:৩৯)


একই সাথে:


"কিন্তু আল্লাহই সর্বোত্তম রক্ষাকারী এবং তিনি সর্বাধিক দয়ালু।" (সূরা ইউসুফ ১২:৬৪)


আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো বলেন- 


"আর তোমাদের রিজিক আকাশে রয়েছে এবং তোমাদের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে [তা তোমাদের কাছে আসবে]।" (সূরা জারিয়াত ৫১:২২)


তাকওয়া, তাওয়াক্কুল, ইয়াকীন এবং ইস্তিগফারের মাধ্যমে রিজিক অন্বেষণ আমাদের জীবনের সমগ্র পদ্ধতিকে পরিবর্তিত করে। কাজ হয়ে ওঠে ইবাদত, চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে বৃদ্ধির সুযোগ, এবং রিজিক হয়ে ওঠে আল্লাহর ভালোবাসা এবং যত্নের নিদর্শন।


আমাদের মনে রাখা দরকার যে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য: তিনি তাদের জন্য রিজিক প্রদান করবেন যারা তাঁর উপর আস্থা রাখে। আমাদের দায়িত্ব হলো আন্তরিকতার সাথে প্রচেষ্টা চালানো, আল্লাহর সাথে আমাদের আত্মিক সংযোগ বজায় রাখা এবং তাঁর প্রজ্ঞার প্রতি আস্থা রাখা।


"আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর কাজ সম্পন্ন করবেন।" (সূরা তালাক ৬৫:৩)

শেয়ার করুন