২৭ জুলাই ২০২৫, রবিবার, ১০:০৩:৩১ পূর্বাহ্ন
রাখাইন করিডোর নিয়ে মানবকতার আড়ালে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের লড়াই
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-০৭-২০২৫
রাখাইন করিডোর নিয়ে মানবকতার আড়ালে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের লড়াই

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্রুত বদলে যাওয়া ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাখাইন করিডোর এখন কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। শুরুতে উত্তর রাখাইনে ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য এই করিডোর চালুর কথা বলা হলেও এর পেছনে রয়েছে অনেক গভীর কৌশল। রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ আরাকান আর্মির (এএ) হাতে চলে যাওয়ায়, তারা এখন মিয়ানমারের একটি বড় অংশে প্রভাব বিস্তার করছে। এই করিডোর ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা আরও বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের অবস্থানও এতে জটিল হয়ে উঠেছে।


মানবিক করিডোরের কৌশলগত দিক

এই করিডোরকে জনসমক্ষে ত্রাণ সহায়তার রুট হিসেবে তুলে ধরা হলেও, এর মাধ্যমে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেখছে পশ্চিমা শক্তিগুলো। উত্তর রাখাইনে দুই মিলিয়নের বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষ, সংঘাত ও বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকিতে আছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কক্সবাজার সফরে যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাণ কমানোকে ‘অপরাধ’ বলেও অভিহিত করেন। কিন্তু অনেকের মতে, এই করিডোর শুধু মানবিক সহায়তা নয়, বরং বঙ্গোপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুটে পশ্চিমা প্রভাব বিস্তারের একটি কৌশল।


জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের প্রস্তাবিত এই করিডোর দেশের সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এটিকে ‘রক্তাক্ত করিডোর’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেন, এটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। এই করিডোর পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য চীনের আশেপাশের অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের একটি সুযোগ হয়ে উঠতে পারে।


বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ দ্বিধা

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এই করিডোরে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তবে দেশের সেনাবাহিনী এটিকে ‘কৌশলগত ফাঁদ’ হিসেবে দেখছে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সেনাপ্রধানের বক্তব্য ইউনূসের অবস্থান দুর্বল করছে। সেনা ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে এই মতবিরোধ হঠাৎ তৈরি হয়নি। অনেকেই এটিকে ১৯৮০ দশকের পাকিস্তানের অবস্থার সাথে তুলনা করছেন, যখন মার্কিন মদতে আফগান মুজাহিদিনদের সমর্থন করতে গিয়ে পাকিস্তান দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশও একই পথে না হাঁটে, এটাই সেনাবাহিনীর উদ্বেগ।


চীনের উদ্বেগ ও কৌশল

রাখাইন করিডোরের প্রতি চীনের মনোভাব স্পষ্টতই নেতিবাচক। কারণ, দক্ষিণ রাখাইনে কিয়াকফিউ বন্দরের মাধ্যমে চীন একটি স্থল-সমুদ্র করিডোর গড়ে তুলছে, যা মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করে। এই করিডোরে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ চীনের এই কৌশলকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। চীন মিয়ানমার সেনা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং আরাকান আর্মির মতো গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে পরোক্ষভাবে যোগাযোগ রাখছে। ফলে, মানবিক করিডোরের মাধ্যমে এএ-র ক্ষমতা বাড়ানো চীন সহ্য করতে পারবে না।


ভারতের কৌশলী নিরবতা

ভারত একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হলেও, রাখাইন বিষয়ে তার অবস্থান অনেকটাই চীনের সাথে মিল রয়েছে। ভারত ‘কালাদান প্রকল্প’-এ বিপুল বিনিয়োগ করেছে এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে রাখাইনের স্থিতিশীলতা চায়। তবে, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এই অঞ্চলে সক্রিয়তা ভারত মানতে পারবে না। ফলে, ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এখন জেনারেল ওয়াকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন।


ভারত এএ-র সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রাখছে বলে জানা যাচ্ছে, বিশেষত মিজোরামে। যদিও প্রকাশ্যে তারা কোনো পক্ষ নেয়নি, বরং নরম সহায়তা ও কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করছে।


আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ ও সম্ভাব্য ঝুঁকি

বর্তমানে আরাকান আর্মি রাখাইনের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে, যার মধ্যে অনেক সীমান্তবর্তী শহর রয়েছে। এই প্রভাব তাদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু এর মাধ্যমে তাদের ওপর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসতে পারে, যা মিয়ানমারের আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বাংলাদেশের জন্য এটি বড় কূটনৈতিক ঝুঁকি। কারণ, করিডোরের মাধ্যমে তারা সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং চীন ও মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন বাড়তে পারে।


কৌশলগত ভারসাম্য ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি

রাখাইন করিডোরকে ঘিরে বর্তমান পরিস্থিতি ভবিষ্যতের বড় সংঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। মানবিক সহায়তা এখন একটি বড় কৌশলগত ইস্যুতে রূপ নিয়েছে। সেনাবাহিনী এই করিডোরকে ‘ফাঁদ’ হিসেবে দেখে এবং চীন এতে হস্তক্ষেপের বার্তা দিচ্ছে। ভারত এই অবস্থাকে নিজের শর্তে সামলাতে চাইছে, আর আরাকান আর্মি এই করিডোরকে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ হিসেবে দেখছে।


যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা না দেখালেও, ২০২২ সালের বার্মা আইন এবং সাম্প্রতিক নীতিগত সহায়তা করিডোর পরিকল্পনার আড়ালের কৌশলকে স্পষ্ট করছে।


নির্ধারণী সময়

আগামী কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহ দীর্ঘ মেয়াদে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক চিত্র নির্ধারণ করবে। যদি বাংলাদেশ করিডোর বাস্তবায়নে এগোয়, তাহলে সেনাবাহিনী এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। আবার যদি করিডোর প্রত্যাখ্যান করা হয়, তবে ভারত ও চীনের সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক জোট তৈরি হতে পারে, যারা করিডোর প্রতিহত করতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে।


ভারতের জন্য জেনারেল ওয়াকারকে সমর্থন মানে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষা, বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বাড়ানো এবং মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ আলোচনায় অংশীদার হওয়া। চীনের জন্য করিডোরের ব্যর্থতা মানে তাদের কৌশলগত করিডোর সুরক্ষিত রাখা এবং আমেরিকান প্রভাব হ্রাস।


উপসংহার

রাখাইন করিডোর শুধুমাত্র একটি ত্রাণপথ নয়, বরং এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার একটি প্রতিফলন। এই প্রতিযোগিতা অস্ত্র নয়, বরং রসদ ও অবকাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি সংকটপূর্ণ সিদ্ধান্তের সময়। করিডোর নিয়ে বাংলাদেশের পছন্দ নির্ধারণ করবে তারা স্বাধীনভাবে পথ চলবে, না কি অন্যদের কৌশলগত মঞ্চে পরিণত হবে।


শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন থেকেই যায়—কে নিয়ন্ত্রণ করবে ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার? কার পতাকা উড়বে রাখাইনের বন্দরগুলোয়? এবং কার আদেশে চলবে করিডোর?


শেয়ার করুন