রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে মালিকানা বিরোধসহ পর্যাপ্ত দালিলিক প্রমাণের অভাবে ‘বিতর্কিত’ প্লট অভিনব কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছেন প্রভাবশালীরা। অভিযোগ রয়েছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে হাতছাড়া হচ্ছে এসব প্লট। একেকটি প্লটের দাম ১০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকার বেশি। হাতিয়ে নিতে প্রভাবশালীদের প্লটপ্রতি খরচ পড়ছে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা; যা যাচ্ছে রাজউকের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে।
সূত্র বলেছে, প্লটের মূল নথি গায়েব করে সাজানো তদন্ত, আবার কখনো এখতিয়ার-বহির্ভূত সংস্থা দিয়ে তদন্ত করে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে প্লট। এ পর্যন্ত বিতর্কিত তালিকার ছয়টি প্লট হস্তান্তর হয়েছে। এগুলোর মূল্য ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা। অবশ্য রাজউকের এস্টেট ও ভূমি শাখার কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। রাজউকের চেয়ারম্যান (সচিব) মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেছেন, নিয়ম অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করেই হস্তান্তর করা হচ্ছে।
রাজউক সূত্র বলেছে, গত শতকের ষাটের দশকে বরাদ্দ দেওয়া প্লটগুলোর মধ্যে ৩৯টিকে ১৬-১৭ বছর আগে বিতর্কিত তালিকাভুক্ত করে রাজউক। এগুলোর বেশির ভাগই গুলশানে। এসব প্লটের একেকটির মালিক দাবিদার ২ থেকে সর্বোচ্চ ১০ জন পর্যন্ত। এগুলোর বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ছিলেন মূলত পাকিস্তানের নাগরিক। এগুলো কবজা করতেই নেওয়া হচ্ছে কৌশল।
অনুসন্ধান করে এবং নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, গুলশান আবাসিক এলাকার বিতর্কিত তালিকায় থাকা যে ছয়টি প্লট হস্তান্তর হয়েছে, সেগুলোর একটি সিইএস (ই) ব্লকের ১২৬ নম্বর সড়কের। কয়েক মাস আগে এটি হস্তান্তর করেছে রাজউক। ১৪ কাঠা ১৫ ছটাক আয়তনের ২ নম্বর প্লটটির বর্তমান বাজারমূল্য কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা। প্লটটি হস্তান্তর ও নথি হারানোর বিষয়ে সংস্থার সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মো. নূরুল ইসলামকে আহ্বায়ক ও উপপরিচালক (এস্টেট ও ভূমি) মো. লিটন সরকারকে সদস্যসচিব করে কমিটি করা হয়। নথি অনুযায়ী কমিটি তিনটি সভা করে গত বছরের ৩০ নভেম্বর রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে নথি হারিয়েছে জানিয়ে ছায়া নথি খোলার প্রস্তাব করা হয়। মূল নথি যে শাখায় সংরক্ষণ করা হয়, সেই শাখার দায়িত্বে কমিটির সদস্যসচিব। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ১৯৮৬ সালের নভেম্বরের একটি আমমোক্তারনামা যাচাই করে ২০২২ সালে প্লটটি এক প্রভাবশালীকে দেওয়া হয়।
এ ছাড়া গুলশানের ১৩৫ নম্বর সড়কের ব্লক এসই (বি), ১ নম্বর প্লটের মূল ফটকের একদিকে মালিক হিসেবে সাকুরা সাবেরের নামের সাইনবোর্ড রয়েছে। তবে প্লটে থাকা অন্য একটি সাইনবোর্ডে জামিলা নাহার শেখ গং লেখা রয়েছে। রাজউক সাকুরা সাবেরকে মালিকানা দেওয়ার পর তিনি ইউনিয়ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে দেন।
বিতর্কিত তালিকার আরেকটি প্লট গুলশানের ৫৯ নম্বর সড়কের এনডব্লিউ (ই)-২। লেকপাড়ে এক বিঘা (২০ কাঠা) আয়তনের প্লটটির বর্তমান বাজারমূল্য ১০০ কোটি টাকার বেশি। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) প্লটটি বরাদ্দ দেয় হাফিজা বেগমকে। হাফিজা বেগমকে ‘মৃত’ দেখিয়ে জনৈক ফজলুল হক মোড়ল নিজের নামে প্লটটির নামজারি করান। তাঁর দাবি, হাফিজা বেগমের কাছ থেকে ১৯৬৯ সালে তিনি প্লটটি কিনেছেন। তবে আসিফ আহমেদ নামের এক ব্যক্তি নিজেকে ‘মৃত’ হাফিজা বেগমের ওয়ারিশ (নাতি) দাবি করে আবেদন করেন। এ ছাড়া হাফিজা বেগমও নিজেকে জীবিত দাবি করে অন্য দুজনকে জালিয়াত উল্লেখ করে রাজউকে আবেদন করেন। ত্রিমুখী এই দাবির মধ্যে রাজউক এর একটি পক্ষকে প্লটটি দিয়েছে। এর পেছনে ছিলেন একজন প্রভাবশালী।
বিতর্কিত তালিকায় থাকা ২২ কাঠা আয়তনের গুলশানের ৪৯ নম্বর সড়কের ২ নম্বর প্লটটির মালিকানা দাবিদার আলী আসকার কোরেশি ও এ এইচ মো. আলী হায়দার কোরেশি নামের দুই ব্যক্তি। একজন প্লটে হাসপাতালের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিজের দখলে রেখেছেন, অন্যজন নিজেকে আমমোক্তারনামা বলে মালিক দাবি করছেন। এই প্লট আলী আসকারকে পেতে সহায়তা করছে প্রভাবশালী মহল। জানা গেছে, তাঁকে দেওয়ার আয়োজন সম্পন্ন করেছে রাজউক।
গুলশান জিএস সি/এ ৪৫ নম্বর প্লটটি বরাদ্দ হয়েছিল জনৈক মো. নাঈমের নামে। বরাদ্দের পর থেকেই প্লটটি তৃতীয় এক ব্যক্তি দখলে রেখেছেন। ১০ বছর ধরে প্লটটি হাতিয়ে নিতে উঠেপড়ে লেগেছে বিভিন্ন চক্র। মো. নাঈমকে ‘মৃত’ দেখিয়ে তাঁর ওয়ারিশ দাবি করে আব্দুল কাইয়ূম নামের একজন নামজারির আবেদন করেন। তাঁর আবেদন আমলে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলাকালে মো. নাঈমের আরেক ওয়ারিশ দাবিদার আব্দুল কুইয়ামও নিজ নামে নামজারির আবেদন করেন। বিষয়টি সমাধানে রাজউক যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন মো. নাঈম নিজেকে জীবিত দাবি করে আবেদন করেন। এ পরিস্থিতিতে একটি মহল প্লটটি নিজেদের কবজায় নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
গুলশানের এসডব্লিউসি/প্লট নম্বর ১৩ বরাদ্দ পেয়েছিলেন ফাতেমা জহুরা। শতকোটি টাকা মূল্যের ১৬ কাঠার এই প্লটের বর্তমানে দাবিদার তিনজন। রাজউকে বিভিন্ন সময়ে করা আবেদনে তিনজনই নিজেকে ‘প্রকৃত’ ফাতেমা জহুরা দাবি করেন। এ ক্ষেত্রেও রাজউক একটির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান (সচিব) মো. আনিছুর রহমান মিঞা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিতর্কিত তালিকায় থাকা প্লটগুলো নিয়ে সমাধানে আসতে হবে। বছরের পর বছর এগুলো ধরে রাখা যায় না। তাই কেস টু কেস আমরা প্লট নিয়ে কাজ করছি। কেউ সঠিক কাগজপত্র দেখিয়ে নিতে পারলে নেবে।’ এত বছর পর মালিকানা নিয়ে কীভাবে নিশ্চিত হয়ে প্লট দিচ্ছেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়ম অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করেই যা করার করছি বা করব।’
বিতর্কিত আরও যত প্লট: রাজউকের তালিকা অনুযায়ী গুলশান, বনানী, মহাখালী ও দিলকুশায় সব মিলিয়ে ৩৯টি বিতর্কিত প্লট রয়েছে। এগুলোর প্রতিটির আয়তন প্রায় ১৫ কাঠা থেকে শুরু করে এক বিঘার বেশি। গুলশানের বিতর্কিত অন্য প্লটগুলো হলো—সিইএন (বি) ১৭, এসডব্লিউসি-২, সিইএন (ডি) ২০,১৮ /সি ও ১৮ /ডি, সিইএন (জি) ১৬ /বি, সিইএন (এইচ) ৪, সিইএন (এইচ) ৩২, সিইএস (এ) ৪৭, সিইএস (এফ) ২, সিডব্লিউএন (এ) ১, সিডব্লিউএন (এ) ২, সিডব্লিউএন (এ) ১৮ এ/বি, সিডব্লিউএন (এ) ৪৩, সিডব্লিউএন (বি) ২৮, সিডব্লিউএন (বি) ২৮, সিডব্লিউএন (বি) ৩৪, সিডব্লিউএন (সি) ৩, সিডব্লিউএস (এ) ৮, সিডব্লিউএস (সি) ৫, এনই (বি) ১ /বি, এনই (এম) ৪, এনডব্লিউ (১) ৩, এনডব্লিউ (১) ৬, এনডব্লিউ (কে) ১১, এসডব্লিউ (এ) ২৯, এসডব্লিউ (এইচ) ৭, সিইএন (এ) ১৫ /সি। বনানীতে রয়েছে সি-৯৪, বি-৪৭, আই-৩৮, আই-১৪, জি-২৩, ২২ এবং মহাখালীর ৬০ নম্বর প্লট। এসব প্লট হাতিয়ে নিতেও তৎপরতা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে রাজউকের সূত্র।
গায়েব হয়েছে মূল নথি: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুলশানে ষাটের দশকে বরাদ্দ করা বিতর্কিত প্লট হাতাতে প্রথমেই রাজউক থেকে গায়েব করা হয় মূল নথি। পরে কারসাজির ফটোকপি দিয়ে কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ছায়া নথি খুলে নানা কৌশলে প্লটটি হাতানো হয়। এ ছাড়া রাজউকের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ফাইলপত্র হালনাগাদ করেও কিছু প্লটে নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করছে প্রভাবশালীরা। প্লটভেদে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা অসাধুদের পকেটে যায় বলে অভিযোগ করেন রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা। এসব ফাইল এস্টেট শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার লকারে সংরক্ষণ করা হয় বলেও জানান তাঁরা।রাজউকের সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মো. নূরুল ইসলাম এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কিছু প্লট নানা কিছু বিশ্লেষণ করে বিতর্কিত তালিকায় থাকার পরও ছেড়ে দিতে হয়েছে। তবে আমার আমলে এসব খুব একটা হয়নি। এখানে টাকার কোনো লেনদেন হয়নি।’