রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনে যুদ্ধ করা ভাড়াটে ওয়াগনার বাহিনীর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও প্রিগোজিনকে গ্রেপ্তার ও শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন। আসলে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হচ্ছে কি, এটা কি পুতিনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান?
আজ শনিবার রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সেনাকর্তাদের হুমকি দিয়ে প্রিগোজিন বলেন, ‘দেশের বর্তমান সেনা কর্তাদের গদিচ্যুত না করা পর্যন্ত আমরা থামব না। আমাদের পথে যে আসবে, ধ্বংস হয়ে যাবে।’ এরপর পুতিন রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এক ভাষণে বলেছেন, ‘এই বিদ্রোহ জাতিকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত। এসব বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তির আওতায় আনা হবে দ্রুত।’
ওয়াগনারের নিয়ন্ত্রণ চায় রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রিগোজিনের ‘না’ওয়াগনারের নিয়ন্ত্রণ চায় রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রিগোজিনের ‘না’
এদিকে সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, রোস্তভ সেনা সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে প্রিগোজিনের সেনারা। ওয়াগনার অফিশিয়াল টেলিগ্রাম চ্যানেলে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে প্রিগোজিন বলেছেন, ‘আমরা সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তরে রয়েছি। বিমানঘাঁটিসহ রোস্তভের সামরিক সুবিধাগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’
ভিডিও বার্তায় প্রিগোজিন জানিয়েছেন, তার সেনারা এই শহর অবরুদ্ধ করবে এবং রাজধানী মস্কোর দিকে এগিয়ে যাবে—যতক্ষণ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই সোইগু এবং জেনারেল ভেলেরি গেরাসিমোভ তাদের সঙ্গে দেখা করতে না আসছেন।
এর আগে প্রিগোজিনকে ক্রেমলিন ‘অস্ত্রধারী বিদ্রোহী’ বলে অভিযুক্ত করার কয়েক ঘণ্টা পরেই তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। প্রিগোজিন বলেন, ‘রুশ বাহিনী আমাদের বিভিন্ন সেনা শিবিরের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এসব হামলায় আমাদের অনেক সহযোদ্ধা সেনাসদস্যের মৃত্যুও হয়েছে। এ কারণে পিএমসি ওয়াগনারের সর্বোচ্চ নির্বাহী ফোরাম কমান্ডার্স কাউন্সিল এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, সামরিক নেতৃত্বের হাত থেকে রাশিয়াকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।’
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ভাষণে পুতিন আরও বলেন, ‘যারা রাশিয়াকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে, তাদের শাস্তি পেতে হবে। তাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। রাজধানী মস্কো এবং অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চলে এখন সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চলছে। আমরা আমাদের উভয় জনগণকে রক্ষা করব।’
রাশিয়া গোলাবারুদ না দিলে বাখমুত থেকে সেনা প্রত্যাহারের হুমকি ওয়াগনারেররাশিয়া গোলাবারুদ না দিলে বাখমুত থেকে সেনা প্রত্যাহারের হুমকি ওয়াগনারের
রোস্তভে বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনের কাজ মূলত অবরুদ্ধ বলে জানিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ঐক্য, একত্রীকরণ ও দায়িত্ব প্রয়োজন।’
রুশ সংবাদ সংস্থা ‘তাস’ জানিয়েছে, সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে রুশ তদন্তকারী সংস্থা এফএসবি। আল জাজিরা সূত্রে জানা গেছে, মস্কোর পথে সাঁজোয়া গাড়ির বহর টহল দিচ্ছে। চাপা উত্তেজনা রয়েছে শহরে। মস্কোর মেয়র সের্গেই সোবয়ানিন সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান, সন্ত্রাস দমনের উদ্দেশ্যে মস্কোয় বেশকিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ওয়াগনার মুখ্য ভূমিকা রেখে আসছে। তাঁরা অসংখ্য ইউক্রেনীয় অঞ্চল দখলে রুশ বাহিনীকে সহায়তা করেছে। তবে সংগঠনটির মালিক প্রিগোজিনের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ রয়েছে। তিনি বেশ কয়েকবার রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সার্জেই শোইগু এবং সেনাবাহিনীর প্রধান ভ্যালেরি জেরাসিমভের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়েছেন। তিনি বারবার এই দুজনকে অযোগ্য এবং ইউক্রেনে যুদ্ধরত ওয়াগনার ইউনিটকে ইচ্ছাকৃতভাবে কম অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার অভিযোগ করেছেন।
গত ৫ মে প্রিগোজিন গোলাবারুদ সংকটে ইউক্রেনের বাখমুত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের হুমকি দেয় রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে। হুমকি দিয়ে এক ভিডিও পোস্ট করেন তিনি। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি নিহত ওয়াগনার সৈন্যদের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে অস্ত্র ও বারুদের সরবরাহ চাচ্ছেন।
রুশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ওয়াগনারের বিদ্রোহ ঘোষণারুশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ওয়াগনারের বিদ্রোহ ঘোষণা
রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং চিফ অফ দ্য জেনারেল স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভের ওপর প্রায়ই ক্ষোভ ঝাড়েন প্রিগোজিন। তিনি অবশ্য জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নানা কথাই বলে থাকেন। পরে তিনি সেগুলোকে কৌতুক এবং সামরিক হাস্যরস বলে উড়িয়ে দেন।
ওয়াগনারকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা মস্কোর
এরপর গত ১২ জুন রাশিয়া ওয়াগনার বাহিনীকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়। এ সময় রুশ উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী নিকোলাই পানকভ বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনটিকে (ওয়াগনার) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সরাসরি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বলা হবে।’ কিন্তু রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তিতে গেলে ওয়াগনারের কলকাঠি আর প্রিগোজিনের হাতে থাকবে না। তাই ঘুরে বসেন প্রিগোজিন।
এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন বলেন, ‘তাঁর বাহিনী এমন চুক্তি বয়কট করবে। ওয়াগনার শোইগুর সঙ্গে কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন না। শোইগু সঠিকভাবে সামরিক বাহিনী পরিচালনা করতে পারে না।’
এবারে ওয়াগনেরর এই বিদ্রোহের দিকে নজর রাখছে পশ্চিমা বিশ্বও। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং মার্কিন মিত্রদের সঙ্গে এ নিয়ে পরামর্শ করবে। বসে নেই ফ্রান্সও। দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ আজ শনিবার বলেছেন, রাশিয়ার বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। পোলান্ডের প্রেসিডেন্টও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন।
তবে প্রিগোজিনের প্রতিবারের উন্মত্ত আচরণের চেয়ে এবারে আচরণে কি ভিন্নতা রয়েছে? তা দেখা যাবে পুতিনের পরবর্তী নির্দেশনা ও অবস্থানে।
গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া তথ্যমতে, ইউক্রেনে ওয়াগনারের ৫০ হাজার ভাড়াটে সেনা রয়েছে। এই ভাড়াটে গোষ্ঠী ক্রমশ বিশ্বজুড়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় শক্তির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সংগঠনটির সেনারা বর্তমানে মালি, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, সুদান এবং লিবিয়াতে মোতায়েন করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।