২৪ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ১২:১৮:৪৬ অপরাহ্ন
জাবির গণরুম: পড়ার সঙ্গী মশার কামড়, ঘুমের সঙ্গী ছারপোকা
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-০৭-২০২৩
জাবির গণরুম: পড়ার সঙ্গী মশার কামড়, ঘুমের সঙ্গী ছারপোকা

জানালার গ্রিলে ঝুলছে জামাকাপড়। মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তেলচটচটে বিছানা। কক্ষের এক পাশ থেকে অন্য পাশে এসব বিছানা মাড়িয়ে যেতে হয়। যেখানে তোশক নেই, সেখানে রাখা ব্যাগ, নিত্যব্যবহারের সামগ্রী। এটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্র সংসদ কক্ষ। 

সাধারণত নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের নানা কার্যক্রম চলার কথা এই ছাত্র সংসদ কক্ষে। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের (জাকসু) নির্বাচন নেই দীর্ঘদিন। ফলে পড়ে থাকা কক্ষটিই থাকার জায়গা বানিয়ে ফেলেছেন হলে আসন না পাওয়া শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ছাত্র সংসদ কক্ষের পাশাপাশি ডাইনিং, টিভি, কমন রুমগুলোতে গাদাগাদি করে থাকছেন ৪০-৫০ জন বা তার বেশি শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বর্ষে উঠলেও অনেকে নির্দিষ্ট আসন পান না।


সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া হলের ছাত্রীরা গণরুম থেকে মুক্তির দাবিতে উপাচার্যের ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। এতে গণরুম বিলুপ্তি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। ছাত্রীদের এ দুই হল ছাড়াও ছেলেদের নয়টি আবাসিক হলেও বিভিন্ন পরিসরে গণরুম আছে।


সম্প্রতি হলগুলোতে ঘুরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষাবর্ষ শেষ হলেও ছেলেদের ৯টি হলে এখনো ৪৩, ৪৪ ও ৪৫ ব্যাচের প্রায় ৭০০ জন অবস্থান করছেন। এতে পরবর্তী ব্যাচগুলোর শিক্ষার্থীদের হলে আসন পেতে জট তৈরি হয়েছে। হলগুলোর গণরুমে থাকছেন প্রথম বর্ষের (৫১তম ব্যাচ) প্রায় ৬০০ জন। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্ররা চারজনের কক্ষে আটজন করে থাকছেন।


বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র আরিফ হোসেন বলেন, হলের ছাত্র সংসদ, টিভি, রিডিং ও কমন রুমে একসঙ্গে গাদাগাদি করে ৪০ থেকে ৫০ জন থাকলে তা গণরুম বলে পরিচিত হয়। এসব কক্ষে শয্যা, চেয়ার ও টেবিল থাকে না। শিক্ষার্থীরা এসব কক্ষে থাকছেন মেঝেতে তোশক বিছিয়ে। রশি টাঙিয়ে রাখছেন জামাকাপড়। প্রতিটি বিছানার মাঝের ফাঁকা স্থানে রাখছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ফলে চলাফেরা, ঘুম, খাওয়া, পড়াশোনা সবই করতে হয় মেঝেতে। হলের ডাইনিং ও কমন রুমে কাটাতে হয় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের।


ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছয়টি হলের মধ্যে চারটিতে প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার আগেই ছাত্রীরা নির্দিষ্ট আসন বরাদ্দ পান। কিন্তু শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া হলে তিন শতাধিক ছাত্রীকে গণরুমে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে।


শেখ হাসিনা হলের টিভি রুমে দ্বিতীয় বর্ষের (৫০তম ব্যাচ) ৯৫ জন ছাত্রী ও ডাইনিংয়ে প্রথম বর্ষের (৫১তম ব্যাচ) শতাধিক ছাত্রী অবস্থান করছেন। এ ছাড়া বেগম খালেদা জিয়া হলের টিভি রুমে প্রথম বর্ষের (৫১তম ব্যাচ) ৯০-৯৫ জন ছাত্রী অবস্থান করছেন। অন্য একটি কক্ষে থাকেন দ্বিতীয় বর্ষের (৫০তম ব্যাচ) প্রায় অর্ধশত ছাত্রী। রিডিং, কমন, নামাজ ঘর ও সাইবার রুমেও গাদাগাদি করে থাকছেন অনেকে।


গণরুমের ছাত্রীদের অভিযোগ, হলে জায়গার তুলনায় শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। এতে পড়াশোনার পরিবেশ ব্যাহত হয়। শৌচাগার-সংকট, রান্না করতে ভোগান্তি, সিনিয়রদের দাপট, ছারপোকার উপদ্রব, দুর্বল ওয়াইফাই সংযোগ, ডাইনিংয়ের পুষ্টিহীন খাবারসহ নানা সমস্যায় ভুগছেন তাঁরা।


খালেদা জিয়া হলের আবাসিক ছাত্রী সোহাগী সামিয়া বলেন, ‘আমরা ৯০-৯৫ জন ছাত্রী এক রুমে থাকি। প্রচণ্ড গরমে গণরুম থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। মশার কামড়ে ইতিমধ্যে কয়েকজন অসুস্থ হয়েছেন। অনেকে আবার সর্দি-কাশিতে ভুগছেন। দ্বিতীয় বর্ষের আপুরাও গণরুমে ৪০-৫০ জন থাকেন।’ 

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দাবি, শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া হলের তুলনায় ছাত্রীদের অন্য হলগুলোতে সংকট কিছুটা কম। শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্ট হোসনে আরা বলেন, হলের সিট ফাঁকা না হতেই আবার নবীন ছাত্রীদের বরাদ্দ দেওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে তাদের গণরুমে থাকতে হচ্ছে। এমনকি তৃতীয় বর্ষের অনেক ছাত্রী ‘মিনি গণরুমে’ থাকছে। বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।


বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুম বিলুপ্তির বিষয়ে এক বছর আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম। এর মাঝে রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে অছাত্রদের হল ছাড়তে দুই দফায় নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে অছাত্রদের তালিকা করতে সব হল প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়।


উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম বলেন, নতুন চারটি আবাসিক হল চালু হলে গণরুম ও আবাসিক সংকট থাকবে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) হলগুলোতে লোকবল নিয়োগের অনুমতি দিচ্ছে না। ২৭ জুলাই ইউজিসিতে গিয়ে হলের আসন-সংকটের বিষয়ে আলোচনা করবেন।


শেয়ার করুন