বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতসহ পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে এত দিন রেলপথে কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। চলতি বছরেই বহুল কাঙ্ক্ষিত সেই অপেক্ষার শেষ হচ্ছে। কক্সবাজারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে রেল যোগাযোগ। ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চলাচল চালু হলে পর্যটকদের যাতায়াত ভোগান্তি কমাবে, সাশ্রয় হবে যাতায়াত খরচও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলক চলাচলের পর আগামী ডিসেম্বরে ঢাকা থেকে কক্সবাজার রেল চলাচল শুরু হবে। ট্রেন চলাচল শুরু হলে পর্যটনশিল্প বিকাশের পাশাপাশি কম খরচে ও কম সময়ে যাতায়ত এবং পরিবহন করা যাবে সামুদ্রিক পণ্য মাছ, লবণ, কাঁচামালসহ নানা দ্রব্য। গতিশীল হবে দেশের রাজস্ব খাত। বাড়বে পর্যটক সমাগম, যা কক্সবাজারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখবে।
জানা গেছে, সড়কপথে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে এখন সময় লাগে প্রায় সাড়ে ১১ ঘণ্টা, ট্রেনে সময় লাগবে মাত্র সাড়ে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা। কমে আসবে পরিবহন ব্যয়ও। ঢাকা থেকে এসি বাসে যেখানে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা খরচ হয়, সেখানে ট্রেনের এসি চেয়ারে বসে কক্সবাজার যেতে খরচ হবে মাত্র ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা।
কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রাম এবং ঢাকাসহ সারা দেশের রেল যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের আরামদায়ক, নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব করতেই এই রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এ লক্ষ্যে ২০১০ সালে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রথম পর্যায়ে চালু হবে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ।
কক্সবাজার ঘুরে দেখা গেছে, রেলপথকে কেন্দ্র করে কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দেরপাড়ায় নির্মাণ হচ্ছে ঝিনুকের আদলে নান্দনিক সৌন্দর্যের আইকনিক রেলস্টেশন। যার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ছয়তলা স্টেশন ভবনের চারতলা পর্যন্ত মূল কাঠামোর কাজও শেষ হয়েছে। স্টেশন ভবন ছাড়া আরও ১৭টি স্থাপনা প্রস্তুত হয়েছে।
১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুট আয়তনের রেলস্টেশনে থাকবে আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা। পর্যটকরা স্টেশনের লকারে লাগেজ রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে পারবেন। একই সঙ্গে পর্যটকরা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করতে পারেন সেজন্য রেলস্টেশনে মার্কেটও স্থাপন করা হচ্ছে। ছয়তলা ভবনের নিচতলায় থাকবে যাত্রীদের টিকিট কাটার ব্যবস্থা। এ ছাড়া ক্যান্টিন, হোটেল, মার্কেটসহ ৫ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার কনভেনশন সেন্টার থাকবে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় প্রশাসন জানায়, ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের ফলে বদলে যাবে কক্সবাজারের দৃশ্যপট। এই অঞ্চলসহ দেশের পর্যটনেও যোগ হবে নতুন দিগন্ত। ঢাকার সঙ্গে ট্রেনের যোগাযোগ ও দৃষ্টিনন্দন রেলস্টেশন নিয়ে উচ্ছ্বসিত তারা।
রেললাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, প্রকল্পের ৮৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে, সামান্য কিছু কাজ বাকি আছে। সেপ্টেম্বরের ১৫ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে চট্টগ্রাম তথা ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি ট্রায়াল রান করা হবে। বাণিজ্যিকভাবে রেল চালু হতে কয়েক মাস সময় লাগবে। চলতি বছরের শেষ দিকে এই রেলপথে আমরা ট্রেন চালুর চেষ্টা করব। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে দুই জোড়া রেল চলবে। পরে রেলের সংখ্যা বাড়ানো হবে। ঢাকা থেকে যেসব রেল চট্টগ্রাম পর্যন্ত আসে, সেসব রেলের শেষ গন্তব্য হবে কক্সবাজার।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতসহ কক্সবাজারকে উন্নতমানের পর্যটন নগরী গড়তে রেলপথও চালু হতে যাচ্ছে। রেলস্টেশনের অত্যাধুনিক ভবন নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দেশের একমাত্র আইকনিক স্টেশন হচ্ছে কক্সবাজারে। যাত্রীরা এখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পাবেন। রেলপথ চালুর পর কক্সবাজারকে নতুন করে চিনবেন পর্যটকরা।
কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া কালবেলাকে বলেন, কক্সবাজার-ঢাকা রুটে রেলপথ চালু হলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হবে। এর মাধ্যমে সহজেই স্থানীয়রা কক্সবাজার থেকে সরাসরি ঢাকায় যেতে পারবেন এবং ঢাকা থেকে কক্সবাজারে আসতে পারবেন।
কক্সবাজার থেকে ঢাকা যেতে বাস কিংবা চট্টগ্রামে গিয়ে ট্রেনে উঠতে হয় এখন। এতে সড়কপথে যানজট বা ভ্রমণ করতে সমস্যা যেমন হয়, আবার সময়ও লাগে বেশি। ব্যবসায়ীদেরও সড়ক বা নৌপথে পণ্য পরিবহন করতে হয়। এতে অনেক সময় নানা সমস্যায় পড়তে হয় তাদের। রেল চলাচল শুরু হলে ঢাকা থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহন করতে পারবেন কক্সবাজারের ব্যবসায়ীরা। তাই কক্সবাজারের সঙ্গে রেল যোগাযোগ এবং আইকনিক রেলস্টেশন ঘিরে স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ এবং উন্মাদনা দেখা গেছে।
স্টেশন এলাকার বাসিন্দারা জানান, বাড়ির কাছেই চট্টগ্রাম বা ঢাকা যাওয়ার ট্রেন আসবে। যে কোনো সময় টিকিট কেটেই কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়া চট্টগ্রাম বা ঢাকায় চলে যেতে পারব। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে আসা পর্যটকরা বলছেন, ট্রেন চলাচল শুরু হলে সড়কপথে ভ্রমণ কিংবা সড়কে যানজটের ফলে ভোগান্তি এড়িয়ে অনেক সহজে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে কক্সবাজার আসতে পারবেন পর্যটকরা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩১ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হচ্ছে। এই পথে রেলস্টেশন থাকছে ৯টি। পুরো প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ৩৯১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭৫২ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০১০ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।