চলতি বছরের ডিসেম্বরেই চালু হতে যাচ্ছে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। শুরুতে ৬০০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট উৎপাদন শুরু করবে। আগামী বছরের এপ্রিলে উৎপাদনে যাবে ৬০০ মেগাওয়াটের আরেকটি ইউনিট। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাতারবাড়ীতে উৎপাদিত এই বিদ্যুৎ ৪০০ কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরীতে সরবারহ করা হবে। একটি ইউনিট চালু হলেই চট্টগ্রামের লোডশেডিং কমে যাবে। আর ২য় ইউনিট চালু হলে চট্টগ্রামের চাহিদা মিটিংয়ে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ অন্য গ্রিডেও সরবারহ করা হবে।
এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ চলছে। আর এই দুই প্রকল্পে পাল্টে যেতে শুরু করেছে এই জনপথের জীবন ও জীবিকার ধরন। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা অঞ্চলটির মানুষ বংশ পরম্পরায় লবণ, পান ও চিংড়ি চাষ ও শুঁটকি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু বন্দর ও বন্দর ঘিরে রাস্তা ও রেল প্রকল্পের জন্য বিশাল পরিমাণ জায়গা অধিগ্রহণের আওতায় পড়ায় অনেকের আর্থিক অবস্থার বিপুল পরিবর্তন এসেছে। বাড়ছে কর্মসংস্থান ও শিক্ষার হার।
মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলার মাতারবাড়ীতে কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জেটিতে ৮০ হাজার মেট্রিক
টন কয়লা নিয়ে ৬টি জাহাজ ভিড়েছে। সেসব কয়লা দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৬০০ মেগাওয়াট আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পাশেই নির্মাণ করা হচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর। যেখানে ভিড়তে পারবে ৮২০০ টিইইউএস ক্ষমতার কন্টেইনার জাহাজ। এই বন্দরের ফলে একদিকে যেমন পণ্য পরিবহনে সময় কম লাগবে, অন্যদিকে সহজ আমদানি-রপ্তানিতে দেশের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসবে। এই দুটি মেগা প্রকল্প ঘিরে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে স্থানীয় অবকাঠামো খাতে। সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থানের।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বাস্তবায়নকারী সংস্থা কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডডের নির্বাহী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার নাজমুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৮০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা আনা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ চলমান রয়েছে। আগামী মাসে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে। আর ডিসেম্বরে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। বাকি ৬০০ মেগাওয়াট সামনের বছরের জুলাইয়ে যুক্ত হবে। কয়লা আনার জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গেই জেটি নির্মাণ করা হয়েছে।
গত শনিবার বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরজমিনে দেখা যায়, মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নের ১ হাজার ৪১৪ একর জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে বিদ্যুৎ প্রকল্পটি। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সাগরের নীল পানি। পরিবেশ দূষণ রোধে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গেই নির্মাণ করা হয়েছে জেটি। সমুদ্রপথে বিদেশ থেকে কয়লা নিয়ে জাহাজ ভিড়ছে সেখানে। পরিবেশসম্মত উপায়ে স্থাপন করা হয়েছে কোল্ড ইয়ার্ড। সাগরে যাতে কোনো প্রকার বর্জ্য যেতে না পারে, সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছে। জেটিতে রাখা জাহাজ থেকে কয়লা নামানোর সময় মাত্র একবার ওই কয়লা দেখা যাবে। এরপর ওই কয়লা সরাসরি প্ল্যান্টে চলে যাবে। কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে।
দেখা যায়, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে নানারকম শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। গড়ে তোলা হয়েছে স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মাতারবাড়ীর মূল সড়কের সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেতে বিলের মাঝ দিয়ে নির্মিত হয়েছে সড়ক। চলমান রয়েছে ব্রিজের নির্মাণকাজ। বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে এসব সড়ক, ব্রিজ নির্মাণের ফলে মাতারবাড়ি ও ধলঘাট ইউনিয়নের বাসিন্দাদের শহরে যাতায়াতে সহজ হয়েছে। এলাকার অর্থনৈতিক চিত্র এবং জীবনমান পাল্টে যাওয়ার চিত্র এখন দৃশ্যমান। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র মাতারবাড়ীকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করবে। আলো ছড়াবে সারাদেশে। সুবিধা পাবে দেশের মানুষ। আর এই আনন্দে আনন্দিত তারা।
এগিয়ে চলছে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ : ছিল লবণমাঠ। বঙ্গোপসাগর উপকূলে সেই লবণমাঠ খনন করে বানানো হয়েছে জাহাজ চলাচলের কৃত্রিম নৌপথ বা চ্যানেল। ঢেউ আর পলি জমা ঠেকাতে সাগরের দিকে নৌপথের দুই পাশে পাথর ফেলে তৈরি করা হয়েছে ¯্রােত প্রতিরোধক পাথরের বাঁধ। সাগর থেকে এই নৌপথে ঢোকার মুখে হাতের ডানে নির্মিত হচ্ছে টার্মিনাল। নামে মাতারবাড়ী টার্মিনাল হলেও বাস্তবে এই লবণমাঠেই হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। সাগরের নীল পানি ছুঁয়ে হাজার হাজার মাইল সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে এই বন্দরে এসে ভিড়বে পণ্যবাহী জাহাজ। গত শনিবার স্প্রিডবোর্ডযোগে সাগরপথে প্রায় ৭০ কিলোমিটার যাওয়ার পর এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।
বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে ১ হাজার ৩১ একর জায়গার নির্মাণ করা হচ্ছে এই বন্দরটি। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হলে ৮ হাজার ২০০ টিইইউএস ক্ষমতাসম্পন্ন কন্টেনার বহনকারী জাহাজ নোঙ্গর করতে পারবে। ফলে পণ্য নিয়ে চীন, সিঙ্গাপুর, কলম্বো আর মালয়েশিয়ার বন্দরে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আর অপেক্ষায় থাকতে হবে না। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় একটি পণ্যের চালান পাঠাতে সময় লাগে ৪৫ দিন। মাতারবাড়ী বন্দর চালু হলে মাত্র ২৩ দিনেই সরাসরি নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।
জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা, বাংলাদেশ সরকার ও চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০২৬ সালে গভীর সমুদ্রবন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হবে। এ লক্ষ্যে জেটি ও কন্টেনার ইয়ার্ড নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।
প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর পায়রা, সোনাদিয়া ও মাতারবাড়ী নামে তিনটি আলাদা বন্দর তুলনা করে দেখা যায়, বন্দর সুবিধায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে মাতারবাড়ী। দেশে সমুদ্রপথে আমদানি বাণিজ্য সবচেয়ে বেশি হয় চীনের সঙ্গে। মাতারবাড়ী বন্দর হলে চীন থেকে সরাসরি বড় কনটেইনার জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে এখন গড়ে প্রতিটি জাহাজে ১ হাজার ৮৭৮টি কনটেইনার পণ্য আনা-নেয়া হয়। মাতারবাড়ীতে চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলকারী চারটি জাহাজের সমান কনটেইনার আনা-নেয়া করা যাবে এক জাহাজে। বন্দর সুবিধা অনুযায়ী ১৪-১৫ হাজার একক কনটেইনারবাহী জাহাজ ভেড়ানো যাবে। এতে এই বন্দর নতুন করে আশা জাগাচ্ছে আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সমুদ্রপথে মাতারবাড়ীর দূরত্ব ৩৪ নটিক্যাল মাইল। জাহাজে যেতে সময় লাগে ২-৩ ঘণ্টা। সড়কপথে এর দূরত্ব প্রায় ১১২ কিলোমিটার। সময় লাগে ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা। তাই গভীর সমুদ্রবন্দরে সড়ক পথে যাতায়াত সহজ করার জন্য কক্সবাজারের চকরিয়ার ফাসিয়াখালী থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে ২৭ দশমিক ২ কিলোমিটার সড়ক। এর মধ্যে মাতারবাড়ী বন্দর থেকে ধলঘাট গোলচত্বর পর্যন্ত সোয়া ১ কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়ক চারলেনে উন্নতি করা হচ্ছে। এছাড়া ধলঘাট থেকে ফাসিয়াখালী পর্যন্ত পণ্য পরিবহনের জন্য ২ লেনের ২৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। যা ভবিষ্যতে ৪ লেনের মহাসড়কে উন্নতি করা হবে বলে জানিয়েছেন সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. জাকির হোসেন।
অবশ্য মাতারবাড়ী বন্দরের কার্যক্রম এগিয়ে যাওয়ার মূল কারণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নৌপথ খনন করে আমদানি করা কয়লা খালাসের টার্মিনাল নির্মিত হয়েছে। একই নৌপথ ব্যবহারের সুবিধা কাজে লাগিয়ে সমুদ্র বন্দরের টার্মিনাল নির্মাণের পথও সুগম হয়েছে।
সরজমিনে মাতারবাড়ী বন্দর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গভীর সমুদ্র বন্দরের জেটি ও কন্টেইনার ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রাংশ এনে সেখানে রাখা হয়েছে। বন্দরের নিরাপত্তায় উত্তর ও দক্ষিণ দিকে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রের ঢেউ প্রতিরোধ বাঁধ।
দেখা যায়, বন্দর ঘিরে কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে মাতারবাড়ী ধলঘাট পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এজন্য বিভিন্ন স্থানে পাথর ও মাটি ভরাট করা হচ্ছে। এছাড়া এ বন্দরের অনেক কাজ এগিয়ে নিয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি। একদিকে মাতারবাড়ী উপকূল, বিশাল বিলের পর মানুষের বসবাস সেখানে। আর সমানের দিকে বিস্তৃর্ণ সাগর। যেদিকে চোখ যায় সূর্যের তীর্যক রোদে নীল জলের মিতালি ঢেউ তালে তালে খেলা করছে। এর বিপরীতে গড়ে উঠছে বিদ্যুৎ প্রকল্প ও সমুদ্র বন্দর। যেন মরুভূমির বুকে জেগে উঠেছে স্বপ্ন।
কয়লাবিদ্যুৎ ও গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্প ঘিরে এখানকার অবকাঠামো ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চিত্রও এখন দৃশ্যমান। এ দুটি প্রকল্প ঘিরে স্থানীয়দের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। তারা এ দুটি প্রকল্পে এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
গভীর সমুদ্র বন্দরটি পড়েছে ধলঘাটা ইউনিয়নে, আর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অর্ধেক ধলঘাটা বাকি অর্ধেক মাতারবাড়ী ইউনিয়নে পড়েছে। এই দুই ইউনিয়নের একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, তারা আগে লবণ উৎপাদন, পান, চিংড়ি ও মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কেউ কেউ শুটকি শুকানো ও সাগরে মাছ ধরার কাজ করতেন। বছরের কয়েক মাস তারা এসব খাতে কাজ করতে পারতেন। বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সমুদ্র বন্দর হওয়ায় তারা এসব প্রকল্পে, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, নদীর বাঁধ নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজ করতে পারছেন। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে এসে এখন প্রকল্পের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন।
জানতে চাইলে কক্সবাজার-২ (কুতুবদিয়া-মহেশখালী) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক ভোরের কাগজকে বলেন, গভীর সমুদ্র বন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এখানকার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ চিন্তা-ভাবনায় মাতারবাড়ীতে বড় দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। বাণিজ্যিক পোর্টটি নির্মাণ হলে শুধু মাতারবাড়ী, কক্সবাজারের মানুষ নয়, সারাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসবে। বন্দরের মাধ্যমে বিশ্বের সঙ্গের বাংলাদেশের সংযোগ বাড়বে। প্রকল্পের কারণে এখানকার রাস্তা-ঘাটসহ অন্যান্য অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। স্থানীয়দের পেশা বদলে গেছে। আগামী প্রজন্মের জন্য স্কুল-কলেজ, ট্রেনিং সেন্টার করা হচ্ছে। এতে তারা দক্ষ হয়ে এসব প্রকল্পেই কাজ করতে পারবে।