২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৭:২৫:৪৯ অপরাহ্ন
যুদ্ধ ঝুঁকি ভাতার ২ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টার অভিযোগ বিএসসির বিরুদ্ধে
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৮-২০২৩
যুদ্ধ ঝুঁকি ভাতার ২ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টার অভিযোগ বিএসসির বিরুদ্ধে

যুদ্ধের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশে গেলে জাহাজের মাস্টার ও নাবিকেরা পেয়ে থাকেন ঝুঁকি ভাতা। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) জাহাজ ভাড়া নেওয়া প্রতিষ্ঠানের (চার্টারার) কাছ থেকে ঝুঁকি ভাতা আদায় করে তা নাবিকদের পরিশোধ করে। সম্প্রতি লিবিয়ায় যাওয়া বিএসসির জাহাজ বাংলার অগ্রদূতের নাবিকদের জন্য চার্টারার প্রায় ২ কোটি টাকা দিয়েছে বিএসসিকে।


কিন্তু বিএসসি সেই টাকা নাবিকদের দিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে বিএসসির দাবি, চার্টারার প্রথমে টাকা দিলেও পরে তা কেটে নিয়েছে।


জানা যায়, লিবিয়া একটি যুদ্ধ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক জয়েন্ট ওয়ার কমিটির তালিকাভুক্ত। এই দেশে জাহাজ নিয়ে যাওয়ার জন্য বিএসসি নাবিক ও কর্মকর্তাদের প্রতিদিনের নিজ নিজ বেতনের ২০০ শতাংশ হারে ঝুঁকি ভাতা দিতে সম্মতি জানায়। এ টাকা জাহাজ ভাড়া নেওয়া ‘ট্রাফিগুরা মেরিটাইম ভেঞ্চারস লিমিটেড’ নামের চার্টারার বিএসসিকে সে অর্থ দিয়েছেও। তবে বিএসসি এই টাকা পরিশোধ না করে উল্টো ঝুঁকি ভাতা দাবি করার বিষয়টিকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ হিসেবে গণ্য করছে। এ নিয়ে জাহাজের মাস্টারের সনদ বাতিলে তাঁর বিরুদ্ধে নৌপরিবহন অধিদপ্তরে অভিযোগ করেছে বিএসসি।


ওই জাহাজের মাস্টার ছিলেন ক্যাপ্টেন মো. কামরুজ্জামান। আরও ২৭ জন কর্মকর্তা ও নাবিককে নিয়ে তিনি যাত্রা করেন। ২৭ মার্চ বেলজিয়ামের অন্তেআপ বন্দর থেকে ট্রাফিগুরা মেরিটাইম ভেঞ্চারস লিমিটেড জাহাজটি ভাড়া নিয়ে তেল তোলে। চার্টারার তাদের তেল খালাসে যেতে চায় লিবিয়ার মিসুরাতা বন্দরে। এই মিসুরাতা যাওয়াকে কেন্দ্র করেই যুদ্ধ ঝুঁকি ভাতা নিয়ে বিএসসির সঙ্গে জাহাজের মাস্টার এবং নাবিকদের জটিলতা দেখা দিয়েছে।


নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, লিবিয়ায় যাওয়ার কথা জানতে পেরে জাহাজের ২৭ জন কর্মকর্তা ও নাবিকই যুদ্ধের ঝুঁকির জন্য সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁরা সবাই লিখিতভাবেই জাহাজের মাস্টারকে বিষয়টি জানিয়ে দেন। লিবিয়ায় যেতে হলে তাঁদের প্রতিদিনের বেতনের ২০০ শতাংশ ঝুঁকি ভাতা দিতে হবে বলেও জানিয়ে দেন। ৩ এপ্রিল ই-মেইলের মাধ্যমে জাহাজের মাস্টার মো. কামরুজ্জামান বিষয়টি বিএসসিকে জানান। এই ই-মেইলের অনুলিপি দেওয়া হয় চার্টারার প্রতিষ্ঠানকেও। ৬ এপ্রিল বিএসসি ফিরতি মেইলে জানিয়ে দেয়, তারা নাবিকদের শর্তে রাজি। পরে সেদিনই জাহাজটি লিবিয়ার সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে। এরপর বন্দরে গিয়ে তেল খালাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ৪৫ দিন পর ২০ মে তেল খালাস করে জাহাজটি বন্দর ত্যাগ করে। এরপর নাবিকেরা ঝুঁকি ভাতা দাবি করলে ২৩ মে ই-মেইলের মাধ্যমে চার্টারার সংস্থা জাহাজের মাস্টারকে জানায়, ঝুঁকি ভাতা বিএসসিকে পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু সেই টাকা এখনো নাবিকদের পরিশোধ করেনি বিএসসি। 


নথিপত্রে দেখা গেছে, জাহাজের মাস্টারসহ মোট ২৮ জনের প্রতিদিনের বেতনের ২০০ শতাংশ হিসাবে ৪৫ দিনে তাঁদের প্রাপ্য ১ লাখ ৭১ হাজার ৭২৩ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।


জাহাজের মাস্টার মো. কামরুজ্জামান বলেন, ঝুঁকি ভাতার বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের জন্য বিএসসি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ঝুঁকি ভাতা দাবি করায় কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে নৌপরিবহন অধিদপ্তরে অভিযোগ করেছে বিএসসি। গত ৬ জুন করা ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, লিবিয়া ওয়ার লাইক এরিয়া তালিকাভুক্ত হওয়ায় জাহাজের কর্মকর্তা ও নাবিকদের মূল বেতনের সমপরিমাণ (১০০ শতাংশ) ঝুঁকি ভাতার প্রাপ্যতা রয়েছে।


কিন্তু বাংলার অগ্রদূতের কর্মীরা বিধিবহির্ভূতভাবে ২০০ শতাংশ দাবি করেন। এ টাকা না পেলে জাহাজটি মিসুরাতা বন্দরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। বাধ্য হয়ে বিএসসি এ শর্তে রাজি হয়। মাস্টারের ইন্ধনে নাবিকেরা এ ধরনের দাবি উত্থাপন করেছিলেন দাবি করে এ অভিযোগে তাঁর সনদ বাতিলের সুপারিশ করা হয়।


এ অভিযোগ পাওয়ার পর নৌপরিবহন অধিদপ্তরের শিপিং শাখা ২২ জুন মাস্টার কামরুজ্জামানকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দেয়। এর জবাবও দিয়েছেন কামরুজ্জামান। মাস্টার নাবিকদের উসকানি দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে চার্টারর দেওয়া টাকা কোথায় গেল, তার তদন্ত দাবি করেন।


কামরুজ্জামান বলেন, ‘জাহাজ পরিচালনার জন্য যখন চুক্তি হয়, তখনই আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে উল্লেখ থাকতে হয় যে যুদ্ধের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় গেলে নাবিকেরা কী পরিমাণে ঝুঁকি ভাতা পাবেন। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বিএসসিকে এই চুক্তি করতে হবে। কিন্তু বিএসসি এই চুক্তি করে না। এ জন্য ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট এই জাহাজটিকেই জার্মানির ব্রেমেনে আটক করেছিল ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন (আইটিএফ)। তখন বিএসসি চুক্তি করার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে সাড়া দেয়নি।’


বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বিএসসি যদি আমাদের সংগঠনের সঙ্গে ঝুঁকি ভাতার পরিমাণ নিয়ে চুক্তি করত, তাহলে এই জটিলতা হতোই না। কিন্তু যেহেতু তারা চুক্তি করে না, সেহেতু আলাপ-আলোচনায় চার্টারার ও বিএসসি যে ঝুঁকি ভাতা দিতে সম্মত হবে, সেটা দিতে তারা বাধ্য।’


জানতে চাইলে বিএসসির এমডি কমোডর মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘বাংলার অগ্রদূতের মাস্টার নাবিকদের নিয়ে আমাদের একরকম জিম্মি করেছিলেন। দেশের বাইরের চার্টারারের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন। বিরাট আর্থিক ক্ষতির কথা বিবেচনায় ওই সময় চার্টারার এবং আমরা মাস্টার ও নাবিকদের দাবি অনুযায়ী ঝুঁকি ভাতা দিতে রাজি হয়েছিলাম। চার্টারার টাকাও দিয়েছিল। কিন্তু পরে সব হিসাব-নিকাশ শেষে সমন্বয়ের সময় চার্টারার আর ওই টাকা দেয়নি। ফলে আমরাও নাবিকদের টাকাটা দিতে পারব না।’


জিয়াউল হক বলেন, ‘জাহাজের মাস্টার কামরুজ্জামান নাবিকদের উসকানি দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ করেছেন। যাত্রা শেষে অনুমতি ছাড়া জাহাজ থেকে প্রায় ১৫ হাজার ডলারও নিয়ে গেছেন। আমরা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করব।’ 


শেয়ার করুন