বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারায় পরিবর্তন এনে আইনটি নতুন নামে প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই আইনের পরিবর্তিত নাম হবে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’। আগামী সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় সংসদ অধিবেশনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ পাস করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে নতুন আইনের খসড়ায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর দুপুরে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সামনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোন কোন জায়গায় পরিবর্তন আসছে, তা তুলে ধরেন আইনমন্ত্রী। মোটা দাগে এই আইনে পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি জানান, প্রস্তাবিত নতুন আইনে সাজা যেমন কমানো হয়েছে, তেমনি অনেকগুলো অজামিনযোগ্য ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। তবে সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক যেসব ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আছে, সেগুলো প্রস্তাবিত নতুন আইনে অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খুবই বিতর্কিত একটি ধারা হলো ২৮। জামিন অযোগ্য এই ধারা অনুযায়ী, ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত এমন কিছু ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে প্রকাশ করা অপরাধ বলে গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তি এই অপরাধ সংঘটন করলে তিনি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সাজা আরও বেশি হবে। কিন্তু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে এটি (২৮ ধারা) পরিবর্তন করে জামিনযোগ্য করা হয়েছে এবং সাজাও কমানো হয়েছে। এখন এই অপরাধে সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছর।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আরেক বিতর্কিত দিক হলো ধারা ২৯। এই ধারার বিষয়বস্তু ছিল মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও সম্প্রচার। ধারাটি সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।
এতে বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোডের (দণ্ডবিধি) সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, সে জন্য তিনি অনধিক তিন বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১)-এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
প্রস্তাবিত আইনে এই অপরাধের জন্য কারাদণ্ড বাদ দিলেও জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। এখন এই অপরাধের জন্য অনধিক ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
২৫ লাখ টাকা জরিমানা অনেক বেশি, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব নয়। তাই এই জরিমানার বিধান বাস্তবসম্মত কি না জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, অনধিক ২৫ লাখ টাকা বলা হয়েছে। তবে আদালত চাইলে ১ টাকাও জরিমানা করতে পারবেন। এটি সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার।
প্রস্তাবিত আইনে বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২১, ৩১ ও ৩২-এ পরিবর্তন এনে সাজার পরিমাণ কমানোর কথা বলা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার অপপ্রচার করলে অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল। নতুন আইনে এই সাজা কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে।
বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় এমন কিছু ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে প্রকাশ করলে অপরাধী অনধিক ৭ বছর কারাদণ্ড, বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই বিধান আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারায়। প্রস্তাবিত আইনে এই ধরনের অপরাধের সাজা কমিয়ে ৫ বছর করা হয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধের বাড়তি সাজা বাতিল করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের জন্য অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল। এটি কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে।
নতুন আইনের কার্যক্রম কখন শুরু হবে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, আগামী সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বিলটি উঠবে। সেই অধিবেশনে আইনটি পাস হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এটি পাস হলে আগের আইনে দায়ের করা মামলাগুলো সাইবার নিরাপত্তা আইনে চলবে বলে জানান আইনমন্ত্রী।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যত মামলা
২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের পর থেকে আইনটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার আসামিদের বড় অংশই সাংবাদিক। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বেশির ভাগ মামলা করেছেন ক্ষমতাসীন দল বা তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের লোকেরা। চার বছরে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা এই আইনে ১৪০টি মামলা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কটূক্তি’ করার অভিযোগে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়ায় মামলায় আসামিদের তিনজনের একজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। ৬০ শতাংশ মামলা হয়েছে ফেসবুকে কোনো কিছু লেখা, শেয়ার করা বা সমর্থন জানানোর অভিযোগে।
সিজিএস আরও দেখেছে, ১ হাজার ১০৯টি মামলায় মোট ২ হাজার ৮৮৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২৬ মাসে ডিএসএ আইনে মামলা করেছেন ক্ষমতাসীন দল বা তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। অধিকারকর্মী, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী এবং সাংবাদিকেরা এসব আইনের বেশির ভাগ ভুক্তভোগী। ৮৯০ মামলার মধ্যে ২০৬টি করেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া পুলিশ, র্যাব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য সংস্থাও এই আইনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মামলা করেছে।
সিজিএসের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, অভিযুক্তদের মধ্যে ২০৭ জন সাংবাদিক, ৪১ জন শিক্ষাবিদ, ১০ এনজিও ও অধিকারকর্মী, ২৫৪ জন রাজনীতিক, ৭৯ জন ছাত্র, ৩২ জন সরকারি কর্মচারী, ৫৩ জন বেসরকারি কর্মচারী, ৭৯ জন ব্যবসায়ী, ২১ জন আইনজীবী, ৮ জন ধর্মীয় নেতা, ৩৬ জন অন্যান্য পেশার। ১ হাজার ৪২৪ জনের পেশা জানা যায়নি।