২৩ নভেম্বর ২০২৪, শনিবার, ০৭:২৬:১৫ অপরাহ্ন
গাঁজা গাছ দিয়ে নির্মাণ হচ্ছে পরিবেশবান্ধব টেকসই বাড়ি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-০৮-২০২৩
গাঁজা গাছ দিয়ে নির্মাণ হচ্ছে পরিবেশবান্ধব টেকসই বাড়ি

যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজশায়ারে সবুজ মাঠে ঘেরা একটি ফ্ল্যাট। দূর থেকে দেখে মনে হয় শস্যাগার, কিন্তু ভেতরে প্রবেশের পর ডিজাইন আর জাঁকজমক দেখে আপনি চমকে যাবেন। আরও অবাক হবেন যখন জানবেন, বাড়িটা গাঁজার গাছ দিয়ে তৈরি। গাঁজার গাছের খড়ি দিয়ে বানানো বাড়িটিতে বেশ আলো-বাতাস চলাচল করে, সঙ্গে আরামদায়ক তো বটেই। 


এ বিষয়ে বাড়িটির মালিক জেমা ব্যারন বলেন, ‘বাড়িটির দেয়ালগুলো আমাকে ছোটবেলায় পাটখড়ি দিয়ে ঘর বানানোর দিনগুলো মনে করিয়ে দেয়। এমন বাড়িতে বাস করা বেশ আরামদায়ক। গত বছর শীতকালে ২৪ ঘণ্টাই ঘর গরম ছিল, ফলে আমাদের হিটিং মেশিন চালুই করতে হয়নি।’

হেম্পক্রিটকে কংক্রিটের মতো টেকসই উপকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ কম-কার্বন বিকল্প হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

দ্রুত বর্ধনশীল গাজার গাছ একটি নবায়নযোগ্য সম্পদ। এর কার্বন শোষণ ক্ষমতাও বেশি। যখন বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়, তখন এটিকে সাধারণত ‘হেম্পক্রিট’ বা লাইম হেম্প কংক্রিটে পরিণত করা হয়। এটি তৈরি করা হয় গাঁজার গাছের কাণ্ড, শিকড়, পানি এবং চুনের মিশ্রণে। হেম্পক্রিট ভবনকে শক্তিশালী এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করে। এটি অক্ষত থাকা অবস্থা পর্যন্ত কার্বন শোষণ করতে থাকে। 


সারা বিশ্বের নির্মাণশিল্প এখন কার্বনমুক্ত বাড়ি তৈরির প্রক্রিয়ার দিকে ঝুঁকছে, ফলে টেকসই উপকরণের চাহিদা বাড়ছে। ভবন এবং নির্মাণশিল্প প্রায় ৩৭ শতাংশ বৈশ্বিক কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী। এই শিল্প উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরিত হয় এমন পদার্থ যেমন—কংক্রিট, ইস্পাত এবং কাচের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এমনটি হচ্ছে।


গাঁজার শণের কার্বন শোষণের মতো গুণকে কাজে লাগিয়ে নানা দেশ নির্মাণশিল্পকে আরও টেকসই ও কার্বন নির্গমন মুক্ত করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।


যুক্তরাজ্যের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের জলবায়ু অ্যাকশনের প্রধান ইয়েতুন্দে আবদুল বলেছেন, ‘বিল্ডিং ডিজাইন, নির্মাণ এবং সংস্কারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, এটি হ্রাসে হেম্পক্রিট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, যা যুক্তরাজ্যকে জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সক্ষম করবে।’


ইউরোপীয় কমিশনের মতে, এক হেক্টরের গাঁজার বাগান ৯ থেকে ১৫ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে থাকে। গাঁজার গাছ বাড়তেও সময় নেয় মাত্র পাঁচ মাস। যার অর্থ কার্বন শোষণের ক্ষেত্রে সাধারণ বাণিজ্যিক বনায়নের চেয়ে এটি এগিয়ে। মাটি উর্বর করতে এবং মাটি থেকে ভারী ধাতু অপসারণেও গাঁজার গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 


তবে নির্মাণশিল্পে গাঁজার শণের ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরুর আগে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, সরকারের আইন, প্রযুক্তিগত সনদ এবং গাঁজার চাষ বৃদ্ধি, সরবরাহ, সাশ্রয়ী করার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল এবং অবকাঠামোর পরিবর্তন। 


বর্তমানে গাঁজা গাছের হেম্পক্রিট দিয়ে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাতে স্বল্প বাজেটে বাড়ি তৈরি করছেন পরিবেশ নিয়ে সচেতন স্থপতিরা। এসব অঞ্চলে গাঁজার ওপর নিষেধাজ্ঞা না থাকায় তাঁরা এটি করতে পারছেন। 


হেম্পক্রিট কংক্রিটের মতো স্তরে স্তরে স্থাপন করা যায় না। কাঠ বা পাথরের মতো ভার বহনকারী উপকরণের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু এটি পেট্রোকেমিক্যাল-ভিত্তিক উপকরণ ফাইবারগ্লাস এবং ফোম বোর্ডের চেয়ে কার্বন নিঃসরণ কম করে থাকে।


কেমব্রিজশায়ারে ২০২০ সালে ফ্ল্যাট বাড়িটি নির্মাণ করে লন্ডনের গবেষণা ও ডিজাইন স্টুডিও ‘ম্যাটেরিয়াল কালচার’। সংস্থাটির সহপ্রতিষ্ঠাতা সামার ইসলাম বলেছেন, ‘হেম্পক্রিট সবকিছুই করে। উচ্চ তাপধারণ ক্ষমতার কারণে এটি উত্তপ্ত হয় এবং ধীরে ধীরে তাপ ছাড়ে। পাশাপাশি দিনের বেলা বাড়ির ভেতরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এটি হাইড্রোস্কোপিক হওয়ার ফলে আর্দ্রতা শোষণ করে এবং ছাড়ে।’ 


কেমব্রিজশায়ারের বাড়িটিতে ব্যবহৃত গাঁজার শণ মার্জেন্ট ফার্মের আশপাশের জমি থেকে নেওয়া হয়েছিল। ম্যাটেরিয়াল কালচারস এই প্রকল্পকে ‘চক্রাকার বাস্তুতন্ত্র’ বলে আখ্যা দিয়েছে। আগে থেকেই করে রাখা প্যানেলের তাকে হেম্পক্রিট বসিয়ে বাড়িটির দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। ঘরের ভেতরে হেম্পক্রিটের ওপর কোনো পালিশ দেওয়া হয়নি। এ কারণে বাইরে থেকে দেখতে খড়ের গাঁটের মতো লাগে। অনেকটা পল্লি এলাকার বেড়ার বাড়ির মতো। 


হেম্পক্রিটের একটি অপূর্ণতা হলো এটি বৃষ্টির সংস্পর্শে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ নিয়ে কাজ করছে ম্যাটেরিয়াল কালচারস। প্রতিষ্ঠানটি গাঁজার গাছের ফাইবারকে প্রাকৃতিক চিনির রেজিন দিয়ে তাপীয়ভাবে সংকুচিত করে বৃষ্টি প্রতিরোধী ক্ল্যাডিং প্যানেল তৈরি করছে। 


গাঁজা গাছের শিকড় ছাড়াও বাইরের আঁশযুক্ত ত্বকের ব্যবহারও বেড়েছে। বাস্ট ফাইবার নামে পরিচিত এই অংশ এরই মধ্য মহাকাশ এবং গাড়ি নির্মাণ শিল্পে ফাইবারগ্লাসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ম্যাটেরিয়াল কালচার পূর্ব–সাসেক্সের লুয়েসে নতুন ফিনিক্স প্রকল্পেও গাঁজার শণ ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। 


অবশ্য হেম্পক্রিট নতুন কোনো আবিষ্কার নয়; এটি হাজার হাজার বছর ধরে ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। যাইহোক, গত শতাব্দীতে আরও আধুনিক নির্মাণসামগ্রীর উত্থান হয়েছে। তবে গাঁজা বিনোদনে ব্যবহার হওয়ায় এর শণ ব্যবহারে নানা নিষেধাজ্ঞা এসেছে। 


তবে ফ্রান্সে গাঁজা চাষ কখনোই বেআইনি ছিল না, ফলে নির্মাণশিল্পে গাঁজার ব্যবহারে দেশটি বিশ্বে শীর্ষে। ২০ শতকের শেষের দিকে হেম্পক্রিট আধুনিক প্রযুক্তিতে উৎপাদন শুরু হয় দেশটিতে। ফলে এ উপাদান ব্যবহার করে ফ্রান্সে বহু ভবন নির্মিত হয়েছে। 


হেম্পক্রিট দিয়ে ২০২০ সালে প্যারিসে সামাজিক আবাসন প্রকল্পের সাত তলা বিশিষ্ট একটি ভবন নির্মিত হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছিল প্যারিসভিত্তিক নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘ব্রাগো ফ্রেস্কো’। প্রতিষ্ঠানটি আগের দশকেও বিভিন্ন স্থাপনায় হেম্পক্রিট ব্যবহার করেছিল। তবে এই প্রকল্পে এটির ব্যবহার ছিল সবচেয়ে বেশি। 



সামার ইসলাম বলেন, যুক্তরাজ্যে বড় পরিসরে গাজার শণ দিয়ে বাড়ি নির্মাণ প্রকল্প নেওয়ার এখনো কোনো উদ্যোগ নেই। এর জন্য যন্ত্রপাতি খুবই ব্যয়বহুল এবং সবখানে পাওয়া যায় না। এই পরিস্থিতিতে গাঁজার শণের ব্যবসা, অবকাঠামোর উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উপাদানের ব্যবহারে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এটি না হওয়া পর্যন্ত হেম্পক্রিট ব্যয়বহুল এবং দুষ্প্রাপ্য উপাদান থেকে যাবে। 


গাঁজা চাষে নিষেধাজ্ঞা বাতিল ও এর বহুমুখী ব্যবহারের ফলে হেম্পক্রিটের ব্যবহার বাড়ছে। যদিও বর্তমানে প্রাথমিকভাবে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় এর চাষ হচ্ছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালে শণের জন্য গাঁজার চাষ ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। আর এ সময় ফ্রান্সেই মোট হেম্পের ৭০ ভাগ উৎপাদন হয়েছে। 


গত বছরের নভেম্বরে জাতিসংঘ একটি প্রতিবেদনে গাঁজার শণ শিল্পের নানা সুবিধার তুলে ধরা হয়। জাতিসংঘ পরামর্শ দিয়েছে, গাঁজার শণের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে দেশগুলোকে আইনি অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর সীমাবদ্ধতা কাটাতে হবে এবং উৎপাদন ব্যবস্থার সুবিধার্থে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে।


শেয়ার করুন