২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৭:৩৮:০৩ অপরাহ্ন
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার সুযোগ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০৮-২০২৩
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার সুযোগ

দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা ও সহযোগিতায় এই অভিযান চলছে। ইতোমধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার সক্রিয় তৎপরতা চলছে। অভিযান শুরু করেছে সিঙ্গাপুর, কানাডা, কাতার, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ শহরকেন্দ্রিক বিভিন্ন দেশ। এতে বেশকিছু সম্পদ ও অর্থ পাচারকারীকে আটক করা হয়েছে। সূত্র বলছে, এর ফলে বাংলাদেশের অর্থ পাচারকারীরাও আতঙ্কে রয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ। কারণ, জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে সই করেছে বাংলাদেশ। ফলে সুযোগ কাজে লাগিয়ে আগে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে উদ্যোগ নিতে পারে। তবে এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সংশ্লিষ্ট দেশের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না থাকলে অর্থ ফেরত আনা কঠিন।


জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম রোববার যুগান্তরকে বলেন, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য এটি একটি সুযোগ। এ সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করা উচিত। যেসব দেশে পাচারের অর্থ ধরা পড়ছে, সেখানে বাংলাদেশের কারও অর্থ থাকলে ওই দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।


সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশে কোনো ফৌজদারি অপরাধ থাকলে সেটি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। তিনি বলেন, তবে টাকা ফেরত আনার প্রক্রিয়াটি একটু কঠিন। কারণ, ওই দেশের আইনে কী আছে, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। আদালতের রায় ছাড়া কোনো দেশ টাকা ফেরত দিতে চায় না। কিন্তু সক্রিয় ভূমিকা নিলে ফেরত আনা অসম্ভব না। সবকিছুর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। এছাড়াও পাচার বন্ধে যেসব আইনকানুন রয়েছে, সেগুলো কাজে লাগাতে হবে।


জানা যায়, ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বেপরোয়াভাবে বেড়েছে। ইতোমধ্যে পাচারকারী কিছু ব্যক্তির নাম যুগান্তরসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ৬টি সংস্থার রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য আসছে। এগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে) প্রকাশিত পানামা প্যারাডাইস ও পেনডোরা পেপারস, জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) রিপোর্ট এবং মালয়েশিয়ার প্রকাশিত সে দেশের সেকেন্ড হোম রিপোর্ট। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সিঙ্গাপুরে বেশকিছু বাংলাদেশির অর্থ পাচারের তথ্য মিলেছে। পানামা, প্যারাডাইস এবং প্যানডোরা পেপারস এ পর্যন্ত অর্থ পাচারকারী হিসাবে ৯০ জন ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করেছে।


জিএফআই সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে ২০টি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব। এছাড়া এই অর্থে ৭০৫ বার চাঁদে যাওয়া যায় (ভারতের চন্দ্রাভিযানের খরচ ৮৫০ কোটি টাকা হিসাবে)। বাংলাদেশ থেকে পাচার করা এই অর্থের বড় অংশই শীর্ষ ১০ দেশে। এগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশ থেকে ভারতে অর্থ পাচারের তথ্য আসছে। বর্তমানে এর অধিকাংশ দেশেই অভিযান চলছে।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ন্যাটো সদস্যভুক্ত অন্যান্য দেশ। তবে অনেক আগে থেকেই এই যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন রুশ প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন। পশ্চিমাদের ধারণা, নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আগেই তাদের বিবেচনায় ছিল। ফলে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য কিছু অংশ অন্য দেশে সরিয়ে আনে। এছাড়াও যুদ্ধ শুরুর পর এই অঞ্চলের অনেক দেশের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। ফলে রাশিয়া এবং মিত্র বিভিন্ন দেশের সম্পদের খোঁজে নেমেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত বিভিন্ন দেশ। তাই সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত, কাতারসহ শহরকেন্দ্রিক বিভিন্ন রাষ্ট্রের ওপর নজর রাখছে পশ্চিমারা।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্রে। এক্ষেত্রে কিছু অর্থ পাচারকারীর সুনির্দিষ্ট তথ্য মিলেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি আরোপের ফলে দেশটিতে নতুন করে অর্থ পাচার কমবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। এসব ইস্যুতে বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনুসরণ করে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নেদারল্যান্ডস। ফলে এসব দেশেও পাচারকারীদের স্বস্তি মিলবে না। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ৮ আগস্ট বাংলাদেশ সফর করেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতিবিরোধী সমন্বয়কারী রিচার্ড নেফিউ। এ সময় তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, ভবিষ্যতে ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারা এ দুর্নীতিসংক্রান্ত সমস্যাটিকে অগ্রাধিকার দেবে। তিনি বলেন, আমরা চাই সব দেশ সহযোগিতা করুক। একটি একক দেশ বা প্রতিষ্ঠান এটা করতে পারে না। মাসুদ বিন মোমেন বলেন, তিনি সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে সমাজে কোনো দায়মুক্তি ও বিরূপ প্রভাব না পড়ে। পররাষ্ট্র সচিব জানান, মার্কিন কর্মকর্তা তাকে বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা বিশ্বজুড়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি হাতিয়ার। তিনি বলেন, ‘আমরা দুর্নীতি প্রতিরোধে সক্ষমতা বাড়ানোর কথাও বলেছি এবং যেসব দেশ পাচারকৃত অর্থ পেয়েছিল, তাদের সমর্থনের কথাও বলেছি।’


শেয়ার করুন