০২ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৬:৩৪:৫৬ পূর্বাহ্ন
সড়ক ট্রেন লঞ্চে ঈদযাত্রা: ঢল নেমেছে বাড়ির পথে
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৪-২০২৪
সড়ক ট্রেন লঞ্চে ঈদযাত্রা: ঢল নেমেছে বাড়ির পথে

আপনজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে বাড়ির পথে নগরবাসীর রাজধানী ছাড়ার ঢল নেমেছে। সড়ক-নৌ ও রেলপথ সবখানের বাড়িমুখো যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। যাত্রী সংকটে ভোগা সদরঘাটের লঞ্চগুলোতেও তিল ধারণের ঠাঁই থাকছে না। গার্মেন্ট ছুটি হওয়ায় সড়কপথে গাড়ির চাপও অনেক বেড়েছে। রেলেও রয়েছে যাত্রীর অতিরিক্ত চাপ। যদিও দুর্ভোগ উপেক্ষা করে আপন নীড়ে ছুটে চলা মানুষের মনে বইছে খুশির বন্যা। আপনজনদের সান্নিধ্য তাদের পথে ভোগান্তির সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে।


সড়ক, রেল ও নৌপথে ঈদযাত্রার ভোগান্তি আজ আরও বেশি হতে পারে বলে শঙ্কা করা হয়েছে। যদিও হাইওয়ে ও জেলা পুলিশ ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে তৎপর রয়েছে। তবে একসঙ্গে অনেক বেশি যাত্রী সড়কে নেমে পড়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় মাঠে নেমেছে কমিউনিটি পুলিশ, রোবার স্কাউট, বিএনসিসি। তাদের সমন্বিত এই তৎপরতা অব্যাহত থাকলে ঈদযাত্রার দুর্ভোগ অনেকাংশে লাঘব করা সম্ভব।


সরেজমিন দেখা গেছে, সোমবার ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়তে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্লাজায় স্বাভাবিক দিনের চেয়ে ১৫ থেকে ১৮ হাজার যানবাহন বঙ্গবন্ধু সেতু পারাপার হয়েছে। ঈদের কারণে সেতুতে যানবাহনের চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ। শনিবার রাত ১২টা থেকে সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩৬ ঘণ্টায় ৪৭ হাজার ৫২২টি যানবাহন সেতু পারাপার হয়েছে। এর মধ্যে রোববার রাত ১২টা থেকে সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১৭ হাজার ৭৪২টি যানবাহন সেতু পারাপার করেছে।


সরেজমিন আরও দেখা গেছে, সোমবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রেনগুলো সামান্য দেরি ছাড়া নির্বিঘ্নেই চলাচল করেছে। তবে সন্ধ্যার পর যাত্রীর চাপ বেড়েছে এবং ১ থেকে দেড় ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়েছে অনেক ট্রেন। ফলে যাত্রীদের স্টেশনে এসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে দেখা গেছে। তাড়াহুড়ো করে ট্রেন উঠতে গিয়ে অনেকে জটলা পাকিয়ে ফেলেছেন। তখন অনেককে ট্রেনের জানালা দিয়েও ভেতরে ঢুকতে দেখা গেছে। অবশ্য অন্যান্য বছরের তুলনায় ট্রেনে এখন পর্যন্ত যাত্রীদের দুর্ভোগ অনেক কম। তবে সদরঘাট লঞ্চঘাটে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। যাত্রীর সংকটে ভুগছে লঞ্চ এমন কথা চাউর হলেও গতকাল ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলো সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে।


চন্দ্রা মোড়ে গাড়ির জট : ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা মোড়ে এলাকায় যাত্রীদের ঢল ছিল লক্ষণীয়। ওই এলাকা ও আশপাশের শিল্প-কলকারখানা ঈদের ছুটি ঘোষণায় সকাল থেকেই মহাসড়কের চিত্র পালটে যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র যানজটে পরিবহণ সংকটের ভোগান্তিতে পড়ে অসংখ্য যাত্রী। দুপুরের পর থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুরের কালিয়াকৈরের মৌচাকের তেলিরচালা থেকে কালিয়াকৈর বাজার ও বাইপাস পর্যন্ত এবং কালিয়াকৈর-নবীনগর সড়কের জীরানী থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। গণপরিবহনে ভাড়া বেশি নেওয়ার ফলেও ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।


পুলিশ ও পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের উত্তরবঙ্গের ২২টি জেলার একমাত্র প্রবেশদ্বার চন্দ্রা এলাকা। ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সব শিল্প-কলকারখানা সোমবার ছুটি ঘোষণা করায় সকাল থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যাত্রীদের ঢল নামছে। যাত্রীদের চাপ বাড়ায় বেড়েছে যানজট। সড়কে যানবাহনের চাপ, উলটো পথে অটোরিকশা চলাচল এবং সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে শাখা সড়ক থেকে মহাসড়কে যাত্রী বোঝাই বাস ওঠার কারণে এই যানজটের সৃষ্টি হয়। তীব্র যানজটের কারণে এক ঘণ্টার পথ যেতে সময় লাগছে ২ থেকে ৩ ঘণ্টার বেশি। এতে ঈদে ঘরমুখো মানুষদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যাত্রী এবং চালকদের অভিযোগ আগে থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি না থাকা এবং চন্দ্রা মোড় এলাকার পশ্চিম পাশে সড়ক সরু থাকায় এই যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি ঈদকে কেন্দ্র করে সড়কে একইদিনেই সব শিল্পকারখানা ছুটির কারণে সড়কে যাত্রীদের চাপ বেড়ে যাওয়ায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে সফিপুর থেকে চন্দ্রা, চন্দ্রা থেকে বাইপাইল, চন্দ্রা থেকে মির্জাপুর পর্যন্তও তীব্র যানজট। যাত্রীর চাপ থাকলেও নেই সে পরিমাণ গণপরিবহণ। গণপরিবহণ না থাকায় অনেকে ট্রাক, পিকআপ, অটোরিকশায় গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। তবে পরিবহণগুলোতে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করছেন যাত্রীরা। ভাড়া বেশি চাওয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে যাত্রীদের। নিরুপায় হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক, পিকআপ, মোটরসাইকেলেই নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছেন মানুষ।


সরেজমিন দেখা গেছে, মহাসড়কের সফিপুর থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত যানজটে আটকে দীর্ঘলাইনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সড়কে এত গাড়ির চাপ যে, মোটরসাইকেল নিয়ে যাতায়াতেরও কোনো সুযোগ নেই। চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় যাত্রী বেশি থাকলেও যানবাহনের সংকট থাকায় যাত্রীদের হেঁটে গাড়ির খোঁজ করতে দেখা গেছে। এছাড়া যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া বেশি আদায়েরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। মহাসড়কের সফিপুর বাজার এলাকায় উড়াল সেতুর নিচে সড়কের ওপর ভাসমান দোকানপাট না সরানোর কারণে যানবাহনগুলো ধীরগতিতে চলতে দেখা গেছে। এছাড়া মহাসড়ক ঘেঁষে বিভিন্ন শাখা সড়ক থেকে যাত্রী নিয়ে আসা যানবাহনগুলো মহাসড়কে উঠতে গিয়ে সড়কে চলাচলরত যানবাহনগুলোর গতি কমিয়ে দিচ্ছে। মহাসড়কের পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় উলটো পথে চলছে অটোরিকশা। এতে যানবাহনের চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যার ফলে যানজট সৃষ্টি হয়েছে।


হাইওয়ে পুলিশের কোনাবাড়ী থানার ওসি শাহাদাত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, যাত্রীদের নির্বিঘ্নে বাড়ি যেতে সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মাঠে কাজ করছেন। ভাড়া বেশি নেওয়ার অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


পদ্মা সেতুমুখো সড়কে স্বস্তিতে যানবাহন চলাচল : ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে এবং পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়া যানবাহনগুলো তেমন ভোগান্তি ছাড়াই নির্বিঘ্নে চলাচল করছে। গতকাল বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীবাহী বাস ও ব্যক্তিগত যানবাহনে মোটরসাইকেলের দীর্ঘসারি তৈরি হয়েছিল। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে পরে পর্যায়ক্রমে যানবাহনের ভিড় বাড়ে পদ্মা সেতুর টোল প্লাজা এলাকায়। এরপর ধীরগতিতে থেমে থেমে যানবাহন চলাচল করেছে।


পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, এবার ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে ৭টি টোল বুথে যানবাহনের টোল আদায় করা হচ্ছে। তবে মোটরসাইকেলের বাড়তি চাপ থাকায় আলাদা লেন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। অন্যদিকে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতে ও ওভার ট্রাকিং বন্ধে স্পিডগানের মাধ্যমে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে হাইওয়ে পুলিশ।


পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজার ম্যানেজার আহমেদ হক যুগান্তরকে জানান, যেহেতু সরকারি-বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গার্মেন্ট ছুটি হয়েছে। এজন্য সড়কে বিড়ম্বনা একটু হবে। তবে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া পরিবহণগুলো পদ্মা সেতু অতিক্রম করে দ্রুতগতিতে। আগামীকাল (আজ) সকাল থেকেই যানবাহনের বাড়তি চাপ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এবার ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষের ভোগান্তি নিরসনে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষের।


হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাঞ্চন কুমার সিংহ যুগান্তরকে বলেন, যানজট নিরসনে এবার বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে মহাসড়কে কাজ করছে হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা। পাশাপাশি অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্নভাবে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সিসিটিভির মাধ্যমেও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে পরিস্থিতি।


লঞ্চে উপচে পড়া ভিড় : সোমবার সদরঘাটের ঢাকা নদীবন্দরে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে। সেই সঙ্গে প্রায় লঞ্চেই অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণ করতে দেখা গেছে। লঞ্চ টার্মিনাল, পন্টুনেও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। লঞ্চগুলোতে ছাদ ছাড়াও ডেকের বিভিন্ন স্থানেও যাত্রীরা অবস্থান নিয়েছে। অধিকাংশ কেবিন অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। বরিশালগামী লঞ্চগুলোতে ডেক যাত্রীদের ৫০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা, ডাবল কেবিন ৩ হাজার টাকা ও ভিআইপি কেবিন ১ হাজার ২০০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এছাড়া চরফ্যাশন, বেতুয়া, হাতিয়া, আমতলী, বরগুনা ও ভোলা রুটেও নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৬৫টি লঞ্চ বন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে গেছে। রাত ১২টা পর্যন্ত ১০৫টি লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এবার লঞ্চগুলোতে সুশৃঙ্খল পরিবেশে যাত্রীরা আরোহণ করেছে। ঘাটে যাত্রীদের নিয়ে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত টানাহেঁচড়া চোখে পড়েনি।


ভোলাগামী যাত্রী বাবুল, হাসেমসহ কয়েকজন যাত্রী যুগান্তরকে বলেন, বাসা থেকে সদরঘাট পর্যন্ত আসতেই দিন পার হয়েছে। সদরঘাটে এসেও লঞ্চে কাঙ্ক্ষিত আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে রওয়ানা হয়েছি। সুন্দরবন নেভিগেশনের জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ আবুল কালাম ঝন্টু যুগান্তরকে বলেন, পদ্মা সেতু হওয়ার পর লঞ্চ ব্যবসায় বেশ ব্যাঘাত ঘটেছে। ঈদ ছাড়া অন্যান্য সময় প্রতিটি ট্রিপে লঞ্চ মালিকরা লোকসান গুনছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে সামনে ব্যবসা টিকবে কিনা সন্দেহ আছে। তবে চলতি ঈদ মৌসুমে আশানুরূপ ব্যবসা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।


শেয়ার করুন