সরকারি চাকরি করতেন মোজাম্মেল হক (ছদ্মনাম)। হবিগঞ্জে গ্রামের বাড়ি হলেও চাকরি সূত্রে থাকেন ঢাকায়।
কয়েক মাস আগে চাকরি থেকে অবসর নেওয়া এ সরকারি কর্মকর্তা লোভে পড়ে ৫ লাখ টাকা লগ্নি করেন এমএলএম কোম্পানি এমটিএফইতে। একইসঙ্গে আরও তিন সরকারি চাকরিজীবী সহকর্মীকেও সেখানে লগ্নি করান।
কিন্তু, লগ্নির দেড় মাস অতিবাহিত হলেও দ্বিগুণ লাভ তো দূরের কথা মূলধনও এখন গায়েব। সম্প্রতি গণমাধ্যমে এমটিএফই প্রতারণার সংবাদ পড়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের(সিআইডি) দ্বারস্থ হয়েছেন চারজনই। সশরীরে উপস্থিত হয়ে লগ্নিকৃত টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তারা লিখিত অভিযোগ করেছেন।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, তিন মাসে লাভ হবে দ্বিগুণ! এমন প্রলোভনে পড়ে প্রথমে মোজাম্মেল ৫ লাখ টাকা লগ্নি করেন, এরপর বাকি তিন সহকর্মীও করেন আরও ১২ লাখ টাকা। কিন্তু কেউই পাননি লাভ।
এমনকি প্রতারণার সংবাদ প্রকাশের পর কথিত সেই পরিচিত সিইও এর মোবাইল নাম্বারও বন্ধ। ব্লক হয়েছে এমটিএফইর ওয়ালেটও। সেখানে তারা আর ঢুকতে পারছেন না।
তবে, এ বিষয়ে গত ২৫ আগস্ট (শুক্রবার) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অনলাইন বা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ডলার, শেয়ার বা ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচার কানাডা ও দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ ইনকর্পোরেটেডে (এমটিএফই) প্রতারিত হওয়া গ্রাহকদের কাছ থেকে তথ্য সহায়তা চায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এরপর গত ৫ দিনে সরকারি চাকরিজীবী, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, ব্যবসায়ী ও কলেজ শিক্ষকসহ নানা পেশার শতাধিক ব্যক্তি সশরীরে, ফেসবুকে ও মোবাইল নাম্বারের মাধ্যমে যোগাযোগ করে প্রতারিত হওয়ার কথা পুলিশকে জানিয়েছেন।
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতা ও ধারণার অভাব ছিল –
এ বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের(সিআইডি) তদন্ত সংশ্লিষ্ট সাইবার পুলিশ সেন্টারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অ্যাপস এবং অনলাইনভিত্তিক যেকোনো ব্যবসায় বিনিয়োগকারীদের যথেষ্ট সচেতনতা ও ধারণার অভাব। এমটিএফইতে লগ্নি করা অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন- এমটিএফই সম্পর্কে তারা বিশেষ কিছু জানতেন না।
শুধুমাত্র শুয়ে-বসে তিন মাসে দ্বিগুণ লাভের আশায় লগ্নি করেছেন। অভিযোগকারীদের অনেকেই সামাজিক চক্ষুলজ্জার ভয়ে নিজেদের নাম-পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছার কথাও সিআইডিকে জানান।
রোকনও লাপাত্তা, সিইওর নাম্বারও বন্ধ –
সিআইডিতে অভিযোগ করতে আসা এক ভুক্তভোগী বলেন, সিলেটে মাস তিনেক আগে একটা সেমিনার হয়। সেখানে দাওয়াত পেয়ে যাই। ব্যবসায়িক অনেক আলোচনা হয়। আমার সামনেই পরিচিত একজনের মোবাইলে লাভের টাকা ঢোকে।
তিনি জানান- ‘তিন মাসে লগ্নীকৃত টাকার প্রায় সমপরিমাণ টাকা লাভ পেয়েছেন।’ এটা দেখে আমিও ১৭ লাখ টাকা লগ্নি করি।গত মাসে টাকাও পেয়েছি। কিন্তু এ মাসে আর টাকা আসেনি। এখন খবর পাচ্ছি টাকা নাকি পাচার হয়ে গেছে। ওয়ালেটে আর ঢুকা যাচ্ছে না। কোনো তথ্যও নেই।
সিলেটের এ ব্যবসায়ী বলেন, আমার এই টাকা যদি মারা যায়, পথে বসার দশা হবে। কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যার মাধ্যমে এমটিএফই সম্পর্কে জানা, সেমিনারে যাওয়া, সেই রোকন নামের ব্যক্তিও লাপাত্তা।
তার সিইওর মোবাইল নাম্বারও বন্ধ। উপায়ান্তর না পেয়ে সিআইডির সার্কুলার দেখে ছুটে এসেছি। আমি চাই এটার একটা বিহিত হোক, ভুক্তভোগীরা টাকা ফেরত পাক। প্রতারকরা শাস্তি পাক।
সিআইডিতে আসা এক ভুক্তভোগীর মুঠোফোন থেকে কথা হয় বিল্লাল নামে পুরান ঢাকার আরেক ভুক্তভোগীর সঙ্গে। তিনি বলেন, উভয় সংকটে পড়েছি, লাভের আশায় লগ্নি করে মূলধন হারানোর ঝুঁকিতে আছি। ওয়ালেট কাজ করছে না, সিইওর খোঁজ মিলছে না।
দুই দফায় ২৩ লাখ টাকা লগ্নি করা বিল্লাল বলেন, দিশেহারা অবস্থা আমার। আমি আগে থেকেই জানতাম বাংলাদেশে ক্রিপ্টো ট্রেডিং নিষিদ্ধ। কিন্তু শুধু অধিক লাভের আশায় লগ্নি করছি। দু’মাস টাকাও তুলেছি।
এরপর গত মাস থেকে কোনো সাড়া নাই। টাকা ফিরে পাওয়ার আশাও দেখছি না। এখন সিআইডিতে গিয়ে অভিযোগ করে উল্টো নিজে ফেঁসে যাবো কী না সেটাও নিশ্চয়তা পাচ্ছি না।
সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা বলেন, বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী- এমএলএম ব্যবসা এবং ক্রিপ্টো কারেন্সিতে লেনদেন অবৈধ ও নিষিদ্ধ।
অথচ এমটিএফইতে রেজিস্ট্রেশনের জন্য ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট এবং জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হয়েছে গ্রাহকদের। ভার্চুয়ালি ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ডলার কেনা-বেচা করা হলেও লভ্যাংশ দেওয়া হতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
অথচ ভুক্তভোগী গ্রাহকদের অনেকেই অ্যাপস এবং অনলাইনভিত্তিক যেকোনো ব্যবসায় বিনিয়োগে যথেষ্ট অসচেতন। শুধু লাভের আশায় প্রলোভনের ফাঁদে পা বাড়িয়েছেন। আমরা চাই- নতুন করে এ রকম যেকোনো প্রতারক প্রতিষ্ঠানের প্রলোভনে কেউ পা না বাড়াক।
সিআইডির বিজ্ঞপ্তির পর অভিযোগ ১০০ ছাড়িয়েছে –
সিআইডির সাইবার পুলিশের বিশেষ পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এমটিএফই অ্যাপস রেজিস্ট্রেশন করে নিজস্ব ওয়ালেটে ট্রেড করার জন্য ডলার রাখতে হতো।
ডলারের পরিমাণ অনুযায়ী গ্রাহককে লাভের কথা বলা হতো। ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করলে দিনশেষে পাঁচ হাজার টাকা লাভ হবে এমন কল্পিত মুনাফার ফাঁদে পা দেওয়া বোকামি ছাড়া কিছু নয়। তিনি বলেন, গত ২৫ আগস্ট আমরা এমটিএফইতে প্রতারিত ভুক্তভোগী ও গ্রাহকদের কাছে তথ্য সহায়তা চেয়েছি।
এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করেছেন। তাদের কথা আমরা শুনছি। অধিকাংশই লোভে পড়েই লগ্নি করার কথা জানিয়েছেন। তাদের অনেকে অসচেতন।
পুলিশের কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, কথা বলে যতোটুকু বুঝেছি তা হচ্ছে, যারা সরল, বেশি কথা ছাড়াই যারা কনভিন্স হন- এমন ব্যক্তিরাই ছিল এমটিএফইর টার্গেট।
প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, বিপুলসংখ্যক গ্রাহককে সম্পৃক্ত করতে এমটিএফই সারাদেশেই সেমিনার করেছে। প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে।
এর মাধ্যমে লাখ লাখ গ্রাহককে সম্পৃক্ত করেছে। আমরা এটা নিয়ে বিশদভাবে কাজ করছি। ভুক্তভোগীদের প্রতি অনুরোধ- যোগাযোগ করুন, তথ্য দিন। পরিচয় গোপন রাখা হবে। দেশের টাকা বিদেশে পাচার হওয়া ঠেকাতে সবার সচেতনতাও কামনা করেন তিনি।
কী পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে ও কত গ্রাহক প্রতারণার শিকার- জানতে চাইলে সিআইডির এ কর্মকর্তা বলেন, এটা জানা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তদন্তের আগে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের স্টেটমেন্ট ছাড়া কিছুই বলা সম্ভব নয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বুধবার(৩০ আগস্ট) দুপুরে জানান, এমটিএফইতে প্রতারিত হয়ে অভিযোগ ও যোগাযোগ করা ব্যক্তির সংখ্যা সোমবার পর্যন্ত ছিল ৬৩ জন। সেটা আজ দুপুর পর্যন্ত ১০০ পেরিয়েছে। সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য ধরে তদন্ত চলছে। এরপরই মামলা হবে।
সত্যিকার অর্থে এমটিএফইর টাকা ফেরত পাওয়া কঠিন –
এমটিএফই সম্পর্কে সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, অভিযোগ নিয়ে শতাধিক ভুক্তভোগী আসছেন।
কিন্তু তাদের কেউই মামলা বা লিখিত অভিযোগ করতে চান না। এর মধ্যে অনেক বোঝানোর পর একজন ভুক্তভোগী রাজধানীর খিলগাঁও থানায় মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলায় এমটিএফই প্রতারণা সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
টাকা ফেরত পাওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে কী না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি পরিচিত কাউকে টাকা ধার দেন! সেই টাকা তোলা নিয়েও অনেকের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সত্যিকার অর্থে এই টাকাও ফেরত পাওয়া কঠিন।
অনলাইনে এমটিএফই তো এসেছেই শতভাগ প্রতারণার জন্য। এমন না তারা ব্যবসা করছে, ব্যবসা করতে করতে লোকসান খেয়েছে, অথবা সরকারের রোষানলে পড়েছে।
তাদের টার্গেটই ছিল ভারত, পাকিস্তান, নাইজেরিয়ার মতো বাংলাদেশকেও আলাভোলা মনে করেই প্রতারণা করা। তিনি বলেন, এই টাকা ফেরত পাওয়া সত্যিকার অর্থেই কঠিন। তবে তদন্ত করতে হবে, কথা বলতে হবে। যোগাযোগ করতে হবে।
বাংলাদেশি অপরাধীদের ধরে যতোটা সম্ভব ভুক্তভোগীদের টাকা ফেরতের চেষ্টা করতে হবে। সব টাকা পাচার নাকি কিছু হলেও আছে সেটাও তদন্ত করে দেখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এটা যতোটা না সাইবার অপরাধ তার চেয়েও বেশি তো ফিনান্সিয়াল ক্রাইম রিলেটেড। এটার মূল জিনিসটা কিন্তু দেখে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া এর রেগুলেটরি অথরিটি বডি আছে।
যেসব প্লাটফর্ম ব্যবহার করে ফিনান্সিয়াল ক্রাইম, যেমন- মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস, ই-ওয়ালেট, এগুলো তো তদন্ত বা মনিটরিং করা, সন্দেহজনক লেনদেনকে ধরার দায়িত্ব তো বাংলাদেশ ব্যাংকের।
কারণ, এমটিএফইতে সন্দেহজনক অনেক লেনদেন হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। যেমন- বিকাশ, নগদ ও রকেটে সন্দেহজনক লেনদেন হচ্ছে কী না তা দেখার জন্য আলাদা সিস্টেম আছে।
এমটিএফই কী?
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এমটিএফই হচ্ছে মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ নামে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি (যেমন- বিট কয়েন) ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম। এখানে বিনিয়োগকারীদের উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলানো হয়। অথচ বাংলাদেশে ক্রিপ্টো ট্রেডিং নিষিদ্ধ।
মুনাফা লাভের পাশাপাশি আরেকটি প্রলোভন দেখানো হয়। একজন গ্রাহক যদি নতুন কাউকে এখানে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেন, তাহলে তিনি নতুন গ্রাহকের বিনিয়োগ থেকেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে অতিরিক্ত আয় করতে পারবেন। ডেসটিনি-২০০০, ইউনিপেটু ইউ-এর মতো প্রতারক এমএলএম কোম্পানির মতোই এমটিএফই।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে থাকলেও এমটিএফই নিজেদের কানাডিয়ান কোম্পানি দাবি করে, যার প্রতিষ্ঠাকাল ২০০৫ সালে। তবে বাংলাদেশে এ বছরের জানুয়ারি মাসে তাদের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়।
এমটিএফইর বিরুদ্ধে কানাডিয়ান সিকিউরিটিজ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস (সিএসএ)-এর কাছে প্রতারণার বেশ কয়েকটি অভিযোগও রয়েছে। ইতোমধ্যে অনলাইন ট্রেডিংয়ের নামে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়েছে কোম্পানিটি।
অধিকাংশ বাংলাদেশির ওয়ালেটের ব্যালেন্সে ডলার থাকলেও সেই ডলার তারা তুলতে পারছেন না। এমটিএফই’র গ্রাহকদের ওয়ালেটের ব্যালেন্স ঋণাত্মক বা মাইনাস দেখানো হচ্ছে। অর্থনীতির ভাষায় প্রতিষ্ঠান লোকসান করায় গ্রাহকদের কাছ থেকে তারাই বরং টাকা পাবে বলে দাবি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে এমটিএফইর কত গ্রাহক আছে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেনি। তবে এমটিএফইর হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে মোট ৮ লাখ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে তাদের অ্যাপে।
শুধু বাংলাদেশ নয় দুবাই, ওমান, কাতার সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশিরাও এমটিএফইতে বিপুল পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করেছে। তবে বাংলাদেশে এদের কোনো অফিস নেই।