বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে চারজনই বিরোধে লিপ্ত। অধিকাংশ ফৌজদারি বিরোধ ভূমি-সংক্রান্ত ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিবাদ থেকে সৃষ্ট। এ ছাড়া ছোটখাটো বিবাদও এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
আইনি সহায়তা ও বিচার প্রাপ্তি-সংক্রান্ত এক প্রকল্পের মূল্যায়ন সভায় এ তথ্য তুলে ধরেছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশে গত চার বছরের পরিসংখ্যান থেকে তারা এ তথ্য দিয়েছে।
আরেকটি জরিপের তথ্য দিয়ে আইন মন্ত্রণালয় বলেছে, আইনগত প্রতিকার পেতে আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট সংস্থার (ফরমাল জাস্টিস ইনস্টিটিউট) দ্বারস্থ হচ্ছেন দেশের ১৩ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া ৬৮ শতাংশ মানুষ আনুষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখেন।
স্ট্রেংদেনিং অ্যাকসেস টু জাস্টিস অ্যান্ড লিগ্যাল রিফরমস শীর্ষক কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের ওপর অনুষ্ঠিত বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় এসব তথ্য তুলে ধরেছে আইন মন্ত্রণালয়। ৫ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘মানুষে মানুষে নানা মাত্রিক বিরোধ হতে পারে। ভূমি-সংক্রান্ত বিরোধ ছাড়াও মানুষের মধ্যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট আরও অনেক বিরোধ আছে। সে বিরোধ পাড়া-প্রতিবেশী ছাড়াও মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আইন মন্ত্রণালয় যেহেতু সুনির্দিষ্ট করে ফৌজদারি বিরোধের ক্ষেত্রে ভূমি-সংক্রান্ত বিরোধ বেশি বলে উল্লেখ করেছে, তাই এটার বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না।’
নিজের তথ্য অধিকার কমিশনে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সেখানে তথ্য অধিকার আইন সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়েছে ভূমি বিরোধ নিয়ে। কোন জমির খতিয়ান, কোনটার রেকর্ড, কোনটা দেবোত্তর সম্পত্তি, কোনটা খাসজমি- এ রকম নানা সমস্যা নিয়ে আবেদন জমা পড়ত। সে ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতার সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের যে জরিপ বা তথ্য এর মিল আছে।’
এ ধরনের বিরোধ মোকাবিলায় আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি ভূমি-সংক্রান্ত সেবার ডিজিটালাইজেশন করার ওপর জোর দিয়েছেন সাদেকা হালিম। তিনি বলেন, ‘বিরোধ বাড়ার ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং মানুষের আচরণগত সমস্যা একটি বড় নিয়ামক; তবে এ বিরোধ কমাতে ভূমির তথ্যসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কাজে সমন্বয় এবং স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. রহমত উল্লাহ বলেন, ‘এটি এমন একটি সময়, যখন প্রতিবেশী বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য সম্পত্তির হিসাব নিয়ে প্রচুর বিরোধ হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, আমাদের ভূমিব্যবস্থাটা সঠিক ও সুষ্পষ্ট নয়। আনুষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার ওপর ৬৮ শতাংশ মানুষের আস্থা রাখা সম্পর্কিত আইন মন্ত্রণালয়ের তথ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন ঢাবির এই অধ্যাপক।’
তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয় যে আস্থার কথা বলছে, এটা কতখানি যথার্থ আমার জানা নাই।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিরোধ এখন শুধু জায়গাজমি আর প্রতিবেশীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নগরজীবনেও বিরোধ বাড়ছে। মোবাইল ফোন, গোপন ভিডিওসহ নানাবিধ বিরোধে জড়িয়ে অনেকের প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটছে। শহরাঞ্চলে কিশোর গ্যাং বিরোধের আরেকটি উৎস হিসেবে কাজ করছে।
সমাজবিজ্ঞান বলছে, আগে পরিবার ও সমাজে যে নিয়ন্ত্রণ ছিল এখন সেই নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটেছে। আগে কিশোররা প্রকাশ্যে ধূমপান করলে পাড়া বা মহল্লার মুরব্বিরা শাসন করতেন। এখন চোখের সামনে মাদক সেবন করলেও মুরব্বিরা তাদের ভয় পান কিংবা বিপদ হতে পারে এই ভেবে এড়িয়ে যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘দেশের অধিকাংশ মানুষ বিরোধে লিপ্ত এ কথা ঠিক। তবে পাঁচজনের চারজনই বিরোধ সম্পৃক্ত- আইন মন্ত্রণালয় এ তথ্য কীভাবে, কোন এলাকায় জরিপ চালিয়ে পেয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।’
তিনি বলেন, মানুষে মানুষে এত বেশি বিরোধ তৈরির পেছনে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পরিবর্তিত সংস্কৃতি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে আচরণগত যে পরিবর্তন ঘটছে, সে বিষয়গুলোই কাজ করছে বলে মনে করেন ড. কামাল।
তিনি আরও বলেন, ‘জন্ম থেকেই আমরা ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষার মতো এমন কিছু উপকরণ পাচ্ছি, যা আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় বিরোধকে আরও উসকে দিচ্ছে। আমরা এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করেছি, যা মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। উপরন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও মানুষের মনোজগতের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে, যা এক ধরনের অস্থিরতা ও বিরোধ সৃষ্টিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।’ সূত্র- বাংলাদেশ প্রতিদিন