২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ১২:১৮:২৫ অপরাহ্ন
রাজশাহীবাসীর গর্বের সাত জিআই পণ্য
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৯-২০২৩
রাজশাহীবাসীর গর্বের সাত জিআই পণ্য

চাঁপাইয়ের খিরসার সঙ্গে কিসের ঈর্ষা। সাত সকালে থালা ভর্তি চিড়ার সঙ্গে রাজশাহীর ফজলি আর বগুড়ার দই হলে মন্দ হয় না। শুধু তাই নয়, মাঝ দুপুর হোক বা শেষ বিকেলে কাঁচাগোল্লায় মিষ্টি মুখের স্বাদ দেবে আত্মতৃপ্তি। খাবার শেষে প্রিয়জনের সম্মানে পাঞ্জাবি বা শাড়ি যাই হোক, সিল্কের জুড়ি নেই। আম, দই আর কাঁচাগোল্লা তার সবই রাজশাহী অঞ্চলের। এগুলো ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতির পাশাপাশি রাজশাহীকে করেছে ব্র্যান্ডিং।


আম, দই ও কাঁচাগোল্লা জিআই পণ্যের স্বীকৃতির পরে এই পণ্যগুলোর চাহিদা ও কদর বেড়েছে। জিআই পণ্যের তালিকায় থাকা রাজশাহী-চাঁপাইয়ের ফজলি, ল্যাংড়া, খিরসাপাত, আশ্বিনা আম সারাবছর না মিললেও বছরজুড়ে মিলবে বগুড়ার দই আর নাটোরের কাঁচাগোল্লা। ফলে উত্তরের রাজশাহী বিভাগের যেকোনো জেলা ঘুরে ফেরার পথে সব ছুটে গেলেও অন্তত কাঁচাগোল্লা যে কেউ নিতে পারবেন পরিজনের জন্য। কারণ এই বিভাগের পাবনা-সিরাজগঞ্জ ছাড়া বাকি জেলাগুলোর প্রবেশদ্বার নাটোর।


সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ১৭টি পণ্যের জিআই স্বীকৃতি রয়েছে। বিভাগ হিসেবে ধরতে গেলে রাজশাহী এগিয়ে। এই বিভাগের সাতটি পণ্য পেয়েছে জিআই স্বীকৃতি। রাজশাহী সিল্ক ছাড়া বাকি ছয়টি পণ্য খাদ্য। এর মধ্যে রয়েছে চার জাতের আম ছাড়াও বগুড়ার দই ও নাটোরের কাঁচাগোল্লা।


রাজশাহী বিভাগের সাতটি পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি রয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) বরাবর আবেদনের ফলে জার্নালে প্রকাশের পরে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে মেলে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি। জিআই পণ্যের স্বীকৃতি তালিকায় রয়েছে রাজশাহী জেলার দুটি পণ্য। একটি রাজশাহী সিল্ক ও অপরটি রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম। বেশ কয়েটি জাতের আম নিয়ে রাজশাহী বিভাগের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জিআই পণ্যের তালিকায় উপরে রয়েছে। এই জেলার জিআই পণ্যগুলো হলো- খিরসাপাত আম, ল্যাংড়া আম, আশ্বিনা আম। তবে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মিলে যৌথ স্বীকৃতি রয়েছে ফজলি আম নিয়ে। আর বগুড়ার দই ছাড়াও জিআই পণ্যের স্বীকৃতি মিলেছে নাটোরের কাঁচাগোল্লার।


খিরসাপাত আম:

রাজশাহী অঞ্চলের জিআই পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম। খিরসাপাত জাতের আমটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতির জন্য ২০১৭ সালের দুই ফেব্রুয়ারি আবেদন করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। এরপরে ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায় এটি। আমটি গোল ও মাঝারি আকৃতির। রসাল আমটির মূল বৈশিষ্ট্য হলো এটি আঁশহীন। আর গন্ধ বেশ আকর্ষণীয়। খিরসাপাত আম স্বাদে খুব মিষ্টি। ফলের খোসা সামান্য মোটা, তবে আঁটি পাতলা। সাধারণত জুন মাসের শুরু থেকে আম পাকা শুরু করে। এই আমের ফুল আসা থেকে ফল পরিপক্ব হতে দরকার হয় চার মাস।


রাজশাহী সিল্ক:

২০১৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাজশাহী সিল্ককে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড, রাজশাহী। ২০২২ সালের ২৬ এপ্রিল জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায় রাজশাহী সিল্ক। পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজা-পার্বণ, মিলনমেলা থেকে শুরু করে যেকোনো ধরনের অনুষ্ঠানে সিল্কের তুলনা হয় না। এই পোশাক শীত বা গ্রীষ্ম যেকোনো ঋতুতেই পরার উপযোগী। আর এই গুণের জন্য রাজশাহী সিল্কের কদর যে শুধু দেশেই আছে তা নয়, এর সুনাম রয়েছে বিদেশেও।


ফজলি আম:

একই বছরের ৯ মার্চ ‘ফজলি আম’ জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্র। তবে ফজলি আম নিয়ে নিয়ে আপত্তি তোলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ফলে ফজলি আম রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় ২০২২ সালের ২৯ মে।


ফজলি আমের আরেক নাম ফকিরভোগ। এ ফল দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বদিকে বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে পাওয়া যায়। আমের অন্যান্য প্রজাতির থেকে দেরিতে ফলে এই ফসল। ফজলি আম দীর্ঘ এবং ঈষৎ চ্যাপ্টা। পাকা আমের খোসা কিছুটা হলুদ হয়ে ওঠে। শাঁস হলুদ, আঁশবিহীন, রসালো, সুগন্ধযুক্ত, সুস্বাদু ও মিষ্টি। খোসা পাতলা। আঁটি লম্বা, চ্যাপ্টা ও পাতলা। এই আমে শর্করার পরিমাণ ১৭.৫ শতাংশ। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বা মোটামুটি জুলাই মাসের শুরু থেকে ফজলি আম পাকে।


বগুড়ার দই:

২০১৮ সালে পহেলা জানুয়ারি বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি বগুড়া জেলা শাখা ‘বগুড়ার দই’ জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির আবেদন করে। ২০২৩ সালের ৫ জুলাই বগুড়ার দই জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাই। বগুড়া জেলার নাম শুনলে দইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। ঐতিহ্যবাহী এ খাবার দেশব্যাপী কদর রয়েছে। সুনাম আর স্বাদে বগুড়ার দই অনন্য। জেলার বিভিন্ন উপজেলায়, গ্রামেগঞ্জে গিয়ে কারখানায় সেরা দুধ আনা হয়। এরপরই শুরু হয় মূল প্রক্রিয়া। বগুড়ার বেশির ভাগ কারখানাতেই সনাতন পদ্ধতিতে দই প্রস্তুত করা হয়।


ল্যাংড়া আম:

সুস্বাদু ফল আম। আমের তিনশ’র অধিক প্রজাতি রয়েছে। কিছু কিছু আম আবার স্বাদে-গন্ধে-গুণে অতুলনীয়। বাহারি সব রঙ, আকার, আর স্বাদে ভরপুর আম, ফলের রাজা হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই তো ল্যাংড়া আমকে ফলের রাজা বলা হয়। ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম’কে জিআই পণ্যের স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ল্যাংড়া আম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায় ২০২৩ সালের ৫ জুলাই।


আশ্বিনা আম:

২০১৮ সালে পহেলা জানুয়ারি আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির আবেদন করে। ২০২৩ সালের ২৫ জুন আশ্বিনা আম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায়। অন্য সব আম গাছের সাথে মুকুল আসে আশ্বিনার। তবে এ জাতের আম গাছে থাকে সাধারণত আগস্ট মাস পর্যন্ত। কিছু কিছু এলাকায় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আম পাওয়া যায়।


কাঁচাগোল্লা:

সর্বশেষ চলতি বছরের ৮ আগস্ট জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায় নাটোরের কাঁচাগোল্লা। এর আগে ২০২৩ সালের ৩০ মার্চ নাটোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ জিআই পণ্য হিসেবে নাটোরের কাঁচাগোল্লার স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিলেন।


চাঁপাইনবয়াবগঞ্জের জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খাঁন বলেন, একক জেলা হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সর্বোচ্চ চারটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি আমাদের জন্য একদিকে যেমন গর্বের, তেমনি অন্যদিকে তা বিরাট সম্ভাবনার। বিদেশে আম রপ্তানিতে জিআই স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আশা করছি, আগামী বছর থেকে জিআই স্বীকৃতিকে কাজে লাগিয়ে আমরা বিদেশে আম রপ্তানি বৃদ্ধি করতে পারব। এলক্ষ্যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।


তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। ট্রেডমার্ক ও প্যাটেন্ট অধিদপ্তর কৃষকদের নিবন্ধন শুরু করেছে চলতি বছরে। আগামী বছর থেকেই জিআই স্বীকৃতি পাওয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত, ফজলি, আশ্বিনা ও ল্যাংড়া আমের গায়ে স্টিকার যুক্ত হয়ে দেশে ও দেশের বাইরে বাজারজাত করা হবে। এতে ন্যায্যমূল্য পাবে জেলার আমচাষিরা।


রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, এক্সপোর্ট আইটেম যত বেশি হবে অর্থনীতি তত শক্তিশালী হবে। দেশ, অঞ্চল বা শহর জলবায়ু, সংস্কৃতির সঙ্গে অনন্য বৈশিষ্ট্য হলে তাদের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতির পায়। এর মান বজায় রাখে এক্সপোর্টের ভলিয়মটা বাড়ে। আমাদের দেশের প্রত্যেকটা অঞ্চল থেকে জিআই পণ্য তৈরি করে এক্সপোর্টটা বাড়াতে পারি তাহলে আমাদের রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সূত্র- ঢাকা পোস্ট

শেয়ার করুন