১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পূর্ব বাংলার ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কোলজুড়ে যখন পৃথিবীতে আসেন শেখ হাসিনা তখন বাবা শেখ মুজিব কলকাতায় ব্যস্ত সাম্প্রদায়িক দাঙা প্রশমনে।
সেখানে বসেই প্রথম সন্তানের জন্মের খবর পান শেখ মুজিব। কিন্তু তরুণ বয়সেই প্রথম বাবা হওয়ার অপার্থিব মুহূর্তের বদলে দেশের জন্য করছিলেন কাজ।
এরপর গ্রামের বাড়িতে মা আর দাদা-দাদির সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা শেখ হাসিনা কিশোর বয়সে বাবার হাত ধরে আসেন রাজধানীতে। এরপর বদরুন্নেসা কলেজে থাকাকালীন ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় শেখ হাসিনার। তারপর দেশ স্বাধীনের পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশগড়ার কাজে মনোনিবেশ করেন।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন। কিন্তু বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহেনা।
এরপর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে হাল ধরেন আওয়ামী লীগের। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পরে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
ভিশন-২০২১: ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে দেশ
আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দাবি করে থাকেন, সব সময় নতুন নতুন প্রযুক্তিতে আওয়ামী লীগ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশ স্বাধীনের পর তার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের জন্য তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ১৫টি সংস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ‘ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ)’ এর সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইটের আর্থ স্টেশন উদ্বোধন করেন।
একই সঙ্গে বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে বিজ্ঞানী কুদরাত-এ খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রণয়ন ও শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার করার লক্ষ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা ছিল বঙ্গবন্ধুর সুচিন্তিত ও দূরদর্শী উদ্যোগ।
বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশের ওপর গুরুত্ব দেন। ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাই-টেক পার্ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এরপর ২০০১ সালে নির্বাচনে হেরে গেলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে ‘দিন বদলের’ ডাক দিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামক স্বপ্নের শুরু। সে নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহার ‘রূপকল্প ২০২১’ ঘোষণা করে।
সে ইশতেহারে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ পরিণত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। যদিও সে সময় বিরোধীরা ‘দিবাস্বপ্ন’ বলে উপহাস করেছিল।
তাদের চিন্তাধারাকে ভুল প্রমাণিত করে বাংলাদেশ আজ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে বিপ্লব সাধন করেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পেছনের গল্প বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আজ যেই ডিজিটাল বাংলাদেশে আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি। এটা জয়েরই ধারণা, জয়েরই চিন্তা। কারণ ৮১ সালে এসে যখন বার বার গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করি। তখন বার বার আমাকে গ্রেপ্তার-গৃহবন্দি করা হয়েছে। তখন বাবার বন্ধু আজিজ সাত্তার কাকা জয় ও পুতুলকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। স্কুল থেকেই জয় কম্পিউটার শিক্ষা নেয়। যখন ছুটিতে আসতো কম্পিউটার নিয়ে আসতো। জয়ের কাছ থেকেই আমি কম্পিউটার শিখেছি। ৯১ সালে যখন পার্টির জন্য অনেক দামে কম্পিউটার কিনি, তখনই আমরা আলোচনা করি, কীভাবে দেশে কম্পিউটার শিক্ষা শুরু করা যায়।
তিনি বলেন, ৯৬ সালে যখন আমরা সরকার গঠন করি, জয় আমাকে পরামর্শ দিল কম্পিউটারের ওপর থেকে ট্যাক্স তুলতে হবে, দাম সস্তা করতে হবে। মানুষের কাছে সহজলভ্য করতে হবে, মানুষকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাহলেই মানুষ এটা শিখবে। সেভাবেই কিন্তু আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের যাত্রা শুরু।
ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্জন
১. বাংলাদেশে বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। ফলে সরকারি কোনো বিশেষ ঘোষণা মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে সরাসরি ওইসব ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে বিশ্বের ৯ম দেশ হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে 5G ইন্টারনেট চালু হয় ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর।
২. বর্তমানে বাংলাদেশের নাগরিকরা অনলাইনে আবেদন করে দেশের ৬৪টি জেলায় স্থাপিত ই-সেবা কেন্দ্র থেকে জমিজমা সংক্রান্ত বিভিন্ন দলিলের সত্যায়িত অনুলিপি সংগ্রহ করতে পারে।
৩. বাংলাদেশে অনলাইন বেচাকেনা ও ই-বাণিজ্য ধারণার ব্যাপক বিস্তৃতির কারণে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ই-কমার্স সাইট।
৪. সব শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক অনলাইনে সহজে পাওয়ার জন্য সরকারিভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ই-বই প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। এতে ৩০০টি পাঠ্যপুস্তক ও ১০০টি সহায়ক পুস্তক রয়েছে। দেশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন অনলাইন শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম। যেমন ‘রবি ১০ মিনিট স্কুল’, ‘১০ মিনিট স্কুল’ ।
৫. নাগরিকদের কাছে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন স্থানে ‘টেলিমেডিসিন সেবাকেন্দ্র’ গড়ে তুলেছে। সরকারি হাসপাতালসমূহের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যেকোনো তথ্য বা অভিযোগ মোবাইল ফোনে অথবা ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
৬. বর্তমানে গ্রাহকরা বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস বিল অনলাইনে অথবা মোবাইল ফোনে পরিশোধ করতে পারেন। বর্তমানে প্রায় সব ট্রেন, বাস ও প্লেনের টিকিট অনলাইনে বা মোবাইলে সংগ্রহ করা যায়।
৭. সরকারের বড় বড় উন্নয়নমূলক কাজে টেন্ডার নিয়োগের জন্য বর্তমানে ‘ই-টেন্ডার’ নামক বিশেষ ওয়েব পোর্টাল ব্যবহার করা হচ্ছে বলে এব কাজে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দুর্নীতি হ্রাস পেয়েছে।
৮. ২০১৮ সালের ১২ মে মহাকাশে পাঠানো হয় বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’। একই সঙ্গে ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ বাংলাদেশের ২য় কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু ২ তৈরি ও মহাকাশে উৎক্ষেপণের জন্য রুশ প্রতিষ্ঠান গ্লাভকসমস (Glavkosmos) এর সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি।
ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর
ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য পূরণ করার পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর পথে যাত্রা শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
এর আগে রূপকল্প ২০৪১-এর সমন্বিত পরিকল্পনার জন্য ২০১৫ সালের অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দেন।
এ সময়ের মধ্যে মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারে উন্নীত করে উন্নত দেশে রূপান্তরে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে দারিদ্র্যকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করা।
রূপকল্প ২০৪১-এর এ গুরুত্বপূর্ণ দুটি দর্শন বাস্তবায়নে কয়েকটি কৌশলগত লক্ষ্য ও বেশ কিছু কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এরই মধ্যে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট-এ চারটি মূল ভিত্তিকে কেন্দ্র করে সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছে।