আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে। টানা তিন মেয়াদের এই সরকারের পৌনে পাঁচ বছর ইতোমধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। এখন চলছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সর্বশেষ অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে দেশবাসীর কাছে যে ওয়াদা করেছিল, তার কতটা পূরণ হয়েছে-দ্বাদশ নির্বাচনের আগে সেই প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নতুন নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটির প্রথম সভায় দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, সময়ের সঙ্গে বাস্তবতার আলোকে আগামী নির্বাচনি ইশতেহার প্রস্তুত করা হবে। তিনি কমিটির সদস্যদের বলেন, আমাদের অ্যাকশনে যেতে হবে। এমন ইশতেহার করতে হবে, যাতে নিষেধাজ্ঞা, পালটা নিষেধাজ্ঞার বিষয় ভাবতে হবে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব ভাবতে হবে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, সর্বোপরি ২০৪০ সাল আমাদের মাথায় রাখতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়ে গেছে, এখন স্মার্ট বাংলাদেশ করতে হবে।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটির এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটির আহ্বায়ক কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, বিগত নির্বাচনগুলোয় দেওয়া ইশতেহার মূল্যায়ন করে এবারের নির্বাচনি ইশতেহার তৈরি করা হবে। তবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। কৃষিমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক সমস্যার কারণে কঠিন সময় পার করছি। তাই আগামী দিনে কৃষি, সেবা, শিল্প খাতসহ বিভিন্ন খাতে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারের মূলকথা ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। দলটি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের কাছে কিছু বিশেষ অঙ্গীকার করেছিল। এর মধ্যে ছিল ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ স্লোগান দিয়ে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণের অঙ্গীকার। ‘তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’ স্লোগান দিয়ে তরুণ-যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর এবং কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অঙ্গীকারও ছিল আওয়ামী লীগের ইশতেহারে।
নির্বাচনি ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ, জাতীয় সংসদকে কার্যকর করা এবং সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূলের অঙ্গীকার করেছিল আওয়ামী লীগ। এতে আরও ছিল মেগা প্রকল্পগুলোর দ্রুত ও মানসম্মত বাস্তবায়ন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করা, সার্বিক উন্নয়নে ডিজিটাল প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, দক্ষ ও সেবামুখী এবং জবাবদিহিমূলক জনপ্রশাসন, জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ব্লু-ইকোনমি-সমুদ্রসম্পদ উন্নয়ন এবং নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা দিয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, গত নির্বাচনের আগে ইশতেহারে আমরা যে অঙ্গীকার করেছিলাম, তা একে একে বাস্তবায়ন করছি। দেশের মানুষ তা লক্ষ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছেন, যার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনি অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পথেই আছে। ইতোমধ্যে অধিকাংশ অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করেছে। আর যেগুলো এখনো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি, তা করা হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, এসব অঙ্গীকারের দিকে তারা ফিরেও তাকায় না। ভোট নেওয়ার জন্য নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা এবং অঙ্গীকারের কথা বলতে হয় বলেই তারা বলেন।
গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করার অঙ্গীকার : আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারের ৩.১ অনুচ্ছেদে ‘গণতন্ত্র, নির্বাচন ও কার্যকর সংসদ’ অংশে বলা হয় : বিগত ১০ বছরে (২০০৯-২০১৮) জাতীয় সংসদই ছিল সব রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের চলমান প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার করব। সংসদকে আরও কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, গণমাধ্যম, বিচার বিভাগকে আরও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু গত পৌনে পাঁচ বছরে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ কিংবা জাতীয় সংসদকে আরও কার্যকর করার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বরং এই সময় বিরোধী দল বিএনপির সংসদ-সদস্যরা জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করে সরে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সোহরাব হাসান বলেন, এখন জাতীয় সংসদের বিতর্ক নিয়ে জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গণতন্ত্রকে এ অবস্থায় নিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলেছে। দুদক ছোট ও মাঝারি দুর্নীতিবাজদের ধরলেও রাঘববোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। তার মতে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে মূল ভিত্তি গণতন্ত্র, তা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দুর্বল হয়েছে। নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এটাই আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ওয়াদার বড় বরখেলাপ। ইশতেহারের ৩.২ অনুচ্ছেদে ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষা’ অংশে ছিল সর্বজনীন মানবাধিকার সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে কোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করার অঙ্গীকার। আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে র্যাব এবং এর সাবেক ও সেসময়কার সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা বাংলাদেশে অতীতে কখনো ঘটেনি। মানবাধিকার ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ধারাবাহিকভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এর অর্থ প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে জনবান্ধব হিসাবে গড়ে তুলতে পারেনি।
র্যাব ও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর উদ্বেগ প্রকাশের কারণে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করেন বিএনপিসহ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। জানা যায়, মানবাধিকার ইস্যুতে সরকারের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তার ভিসা প্রত্যাখ্যান করেছে আমেরিকা।
দক্ষ, সেবামুখী ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনের অঙ্গীকার : ইশতেহারের ৩.৩ অনুচ্ছেদে দক্ষ, সেবামুখী ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। কিন্তু জনপ্রশাসনের উচ্চপদস্থ ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্তৃক সাধারণ মানুষ এমনকি গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর চড়াও হওয়ার পাশাপাশি মামলা এবং বিভিন্নভাবে হয়রানির নানা তথ্য পাওয়া গেছে আওয়ামী লীগের তৃতীয় মেয়াদের শাসনামলে। সচিবসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ক্ষমতাসীন দলীয় নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেও দেখা গেছে। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি অঙ্গীকার হোঁচট খেয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।